হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে নিজেদের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত সংস্থার পরিচালন পর্ষদকে জানিয়ে দিল রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। তবে ‘মৃত্যুশয্যায় থাকা’ সংস্থাটিকে বাঁচাতে এক্ষুণি যে- টাকা প্রয়োজন, তার জোগাড় কী ভাবে হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও দিশা দেখাতে পারল না পর্ষদ।
বুধবার দফায় দফায় প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠক শেষে শিল্পমন্ত্রী তথা পর্ষদের চেয়ারম্যান পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই মুহূর্তে সব থেকে বড় সমস্যা অর্থাভাব। তাই প্রথম লক্ষ্য, সেই সমস্যা মিটিয়ে সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল করা। এ জন্য আরও ঋণ পেতে স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, শিল্প সচিব সি এম বাচাওয়াত এবং নিগমের এমডি কৃষ্ণ গুপ্ত।”
শিল্পমন্ত্রীর দাবি, বাম জমানায় ক্রমাগত ঋণ নিলেও, তা ঠিক মতো মেটানো হয়নি। ফলে পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, এখন আর ঋণ দিতে চাইছে না স্টেট ব্যাঙ্কও। এ প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত, এখন সংস্থার উপর ঋণদাতা, বাজার এবং কর্মীদের আস্থা ফেরাতে হবে। দায় কী ভাবে মেটানো সম্ভব, তা খুঁজে বার করাই এই মুহূর্তে সংস্থা কর্তৃপক্ষের দক্ষতার চ্যালেঞ্জ। পার্থবাবুর অবশ্য দাবি, ঋণ পাওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে উদ্যোগী হবে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীও।
হলদিয়া পেট্রোকেমের নিট সম্পদ ১,৭৬০ কোটি টাকা। আর দায় ১,১৫০ কোটির আশেপাশে। পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের মতো কাঁচামাল কেনার টাকা না-থাকায়, মাস তিনেক আগে (পুজোর আশেপাশে) সিদ্ধান্ত হয় কম ন্যাপথা কিনেই কারখানা চালানোর। কিন্তু রাসায়নিক কারখানার ‘অঙ্ক’ অনুযায়ী, একমাত্র ন্যাপথা কেনার খরচ ছাড়া এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ ১১০ টনে যা, ২৫০ টনেও তা-ই। তাই কম উৎপাদন করলে, টন-পিছু উৎপাদন খরচ বাড়ে। আর তাই গত তিন মাসে ২১০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে সংস্থা। |
নিগমে ঢুকছেন পার্থবাবু। —নিজস্ব চিত্র |
এই নিয়ে এ দিন বৈঠকে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী ও সরকার পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। প্রশ্ন ওঠে, কারখানা চালানোর ক্ষেত্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ শরিকদের না-জানিয়ে নেন কী করে? বিশেষত যখন এই ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষতি বাড়বে বলে আগে থেকেই জানা ছিল? হলদিয়ার কারখানা শুধু ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের উপর ভর করে চলছে কি না, প্রশ্ন ওঠে তা নিয়েও।
উল্টো দিকে, সংস্থার ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত কমিটি কেন ‘অকেজো’ হয়ে রয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলে সরকার পক্ষ। পরে পার্থবাবু জানান, প্রায় আট বছর কমিটি কাজ করেনি। অবিলম্বে তার রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দ্রুত সেই কমিটি পুনরুজ্জীবনেরও। তা ছাড়া, অর্থাভাব মেটাতে দেশের বাজারে চুক্তির ভিত্তিতে উৎপাদনের পথও খোলা রাখছে সংস্থাটি।
শেয়ার বিক্রির বিষয়ে অবশ্য আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে রাজ্য। শিল্পমন্ত্রী এ দিনও জানান, সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়। নিগমের সামান্য কিছু শেয়ার রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেওয়ার কথা পর্ষদকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য শীঘ্রই আগ্রহপত্র চাওয়া হবে।
মন্ত্রিগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইচ্ছুক লগ্নিকারীদের কাছ থেকে দরপত্র চাওয়া হবে। সর্বোচ্চ দর যা পাওয়া যাবে, সেই দামেই চ্যাটার্জি গোষ্ঠীকে সরকার তার শেয়ার কেনার সুযোগ দেবে। চ্যাটার্জি গোষ্ঠী রাজি না-হলে, তখন সর্বোচ্চ দরদাতাকে ওই শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দুবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, “আমাদের অবস্থান এ ব্যাপারে অপরিবর্তিত।”
উল্লেখ্য, রাজ্য আগেও জানিয়েছিল, শেয়ার বিক্রির যে-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা পুরোপুরি স্বচ্ছ। অর্থ দফতর থেকে কেপিএমজি-র মতো প্রায় ১৬টি সংস্থার কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এদের সকলেরই এই ধরনের শেয়ার নিলামে সহায়ক হিসেবে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। শেয়ার বিক্রির বিষয়টি পরিচালনার জন্য এদের মধ্যে একটিকেই বেছে নেবে নিগম।
কিন্তু এই মুহূর্তে মূল প্রশ্ন হল, এখন কী হবে? মালিকানার প্রশ্নে বিভিন্ন আদালতে যে-সব মামলা চলছে, বছর তিনেক আগে সেগুলি নিষ্পত্তির সম্ভাবনা দেখছে না কোনও পক্ষই। ফলে, শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়াও কত দিনে শেষ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
অথচ প্রতিদিনই সংস্থা চালাতে খরচের বোঝা বাড়ছে। এখন ৫০০ কোটি পেলে, দৈনন্দিন উৎপাদনের জন্য ২০০ টনের বেশি ন্যাপথা ব্যবহার করা যাবে। তাতে অন্তত কিছুটা শ্বাস ফেলার সময় মিলবে। যদিও পার্থবাবুর দাবি, এই ঋণের প্রয়োজন হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থা সূত্রে খবর, এ দিনের বৈঠক এ পর্যন্ত দীর্ঘতম। শিল্পমন্ত্রী এসে না-পৌঁছনোয় নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পরে বৈঠক শুরু হয়। মাঝে অবশ্য কিছুক্ষণ পার্থবাবু ছিলেন না। বৈঠকে পর্ষদের এগ্জিকিউটিভ সদস্যদের কাছে আলাদা ভাবে কিছু বিষয় জানতেও চায় চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। নতুন শিল্প সচিব ও নিগমের এমডি হিসেবে এ দিন পর্ষদে যোগ দিলেন সি এম বাচাওয়াত ও কৃষ্ণ গুপ্ত। |