কমোডিটি ট্রেডিং
নেকেই বলছেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশন গরম মূলত দু’টি বিষয়ে আলোচনাকে ঘিরে। তার মধ্যে একটি অবশ্যই বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ। যা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। গড়িয়েছে ভোটাভুটি পর্যন্ত। আর অন্যটি আগাম পণ্য লেনদেন নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী বিল। আজকের আলোচনায় এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়েই কথাবার্তা বলব আমরা। দেখে নেব, শেষ পর্যন্ত সত্যিই বিলটি আইনে পরিণত হলে, ঠিক কী কী পরিবর্তন হবে পণ্য লেনদেনের বাজারে।

গোড়ার কথা
ভারতে কমোডিটি এক্সচেঞ্জগুলির বয়স মাত্র বছর দশেক। কিন্তু পণ্য লেনদেন ব্যবস্থার আইন ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। এই বাজারকে অর্থনীতির বড় স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। তাই সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে উন্নয়নের দৌড়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলির আইনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভারতে কিন্তু অর্ধেক শতাব্দী পেরনোর পর এখনও সেই মান্ধাতার আমলের (১৯৫৪ সালের) আগাম পণ্য লেনদেন নিয়ন্ত্রণ আইন (এফসিআরএ) অনুসারেই এই বাজার পরিচালিত হয়। গত কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্র নয়া আইন প্রণয়নের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেও, তা এখনও চালু হয়নি।
লেখার শুরুতেই যে খসড়া সংশোধনী বিলের কথা বলছিলাম, তা প্রথম লোকসভায় পেশ করা হয় ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর। অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে। সম্প্রতি এই বিলে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কিন্তু এই লেখার দিন পর্যম্ত লোকসভায় বিলটি পাশ হয়নি।

নতুনের সঙ্গে পুরনোও
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, নতুন বিল সংসদে পাশ হওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে পুরনো আইন জলে গেল। বরং সেই আইনের বাড়তি মেদ ছেঁটে ফেলে তাকে সময়োপযোগী করে তোলার চেষ্টা হবে নয়া খসড়া বিলে। যাতে তা লগ্নিকারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়।
নতুন বিলে মূলত দু’টি পরিবর্তন হতে পারে—
(১) বাজার নিয়ন্ত্রক ফরওয়ার্ড মার্কেটস কমিশন (এফএমসি)-কে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করার স্বীকৃতি দেওয়া।
(২) ‘অপশন’ লেনদেন চালু করা। এখন আগাম (ফিউচার) লেনদেন চালু থাকলেও, ‘অপশন’ লেনদেন কিন্তু সরকার স্বীকৃত নয়। নয়া বিলে তাতে অনুমতি দেওয়ার কথা রয়েছে।

‘অপশন’ লেনদেন কী?
আগাম লেনদেন নিয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে। এখন দেখা যাক অপশন লেনদেন বলতে কী বোঝায়?
• অপশন লেনদেনের জন্য লগ্নিকারী একটি নির্দিষ্ট দিনে পণ্য কিনতে চুক্তিবদ্ধ থাকেন।
• এ জন্য প্রথমেই নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা (বুকিং প্রিমিয়াম) জমা দিয়ে দিতে হয়।
• চুক্তির শেষ দিন যদি সেই পণ্যের দাম হঠাৎ কমে যায়, তা হলে শুধুমাত্র বুকিং-এর টাকাতেই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। ক্ষতি হবে জেনেও আগাম লেনদেনের মতো বাধ্যতামূলক ভাবে পুরো টাকা দিয়ে সেই পণ্য কিনতে বা বেচতে হবে না। পণ্য বাড়ি নিয়ে যাওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং সব মিলিয়ে সম্ভাব্য ক্ষতিকে সীমিত রাখার কিছু সুযোগ থাকছে আপনার হাতে।
• লাভ করার সুযোগ থাকলে অবশ্য পণ্য বিক্রি করে মুনাফার টাকা ঘরে তুলতে পারেন। বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন পণ্যও। এ ক্ষেত্রে দুই সুযোগই খোলা থাকছে আপনার সামনে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি
এখন: মোট তিনটি স্তর রয়েছে
(১) একেবারে শীর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা এবং খাদ্য ও গণবণ্টন মন্ত্রক।
(২) এর পর বাজার নিয়ন্ত্রক এফএমসি। যা কেন্দ্রের অধীনে থেকে কাজ করে।
(৩) এরও পরের ধাপে রয়েছে এক্সচেঞ্জগুলি। মনে রাখবেন, এরা নিজেরাও কিন্তু এক রকম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। এ জন্য প্রতি মুহূর্তে সদস্য এবং লগ্নিকারীদের বিভিন্ন খুঁটিনাটি নজরে রাখে তারা।

প্রস্তাবিত পরিবর্তন: নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় বদল হতে পারে মূলত তিনটি জায়গায়—
(১) এফএমসি বাজারের নিয়ন্ত্রক হলেও, এখনও তা কাজ করে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নয়। সংশোধনী বিলে এফএমসি-কে কেন্দ্রের অধীনে স্বাধীন সংস্থা (সেল্ফ রেগুলেটরি অর্গানাইজেশন) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তা কার্যকর হলে, অনেক বেশি ক্ষমতা পাবে তারা। ঠিক যে-ভাবে স্বাধীন সংস্থা হওয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি।
এ কথা ঠিকই যে, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পরেও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এফএমসি-কে নির্দেশ দেওয়ার অধিকার থাকবে কেন্দ্রের। কিন্তু তেমনই বাজার পরিচালনার অন্য অনেক বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এফএমসি। যেমন, সঠিক তথ্য জমা না-দিলে কোনও সংস্থাকে জরিমানা করা, বেআইনি ভাবে গোপন তথ্য ফাঁস রুখতে আইন তৈরি, বেআইনি লেনদেনের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে লাভের রাস্তা বন্ধের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
(২) আগাম পণ্য লেনদেনের বাজারে সমস্ত সংস্থাই আসবে এফএমসি-র ছাতার তলায়। এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো পণ্য লেনদেন করছে। বাজারের নিয়ম না-মেনেই। কিন্তু বাধ্যতামূলক ভাবে এফএমসি-র কাছে নথিভুক্ত হলে, তা চলবে না। স্বচ্ছ হবে লেনদেন ব্যবস্থা। সুবিধা হবে লগ্নিকারীদের।
(৩) এফএমসি-র পরিচালন পর্ষদের সদস্য সংখ্যা চার থেকে বাড়িয়ে নয় করার প্রস্তাব রয়েছে। এঁদের মধ্যে এক জনকে চেয়ারম্যান স্তরের এবং তিন জনকে বাধ্যতামূলক ভাবে সর্বক্ষণের সদস্য হতে হবে। নেওয়া যাবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও।

শিকে ছিঁড়বে ‘অপশন’ লেনদেনের
বর্তমান আইন অনুযায়ী, এই বাজারে শুধুমাত্র আগাম পণ্য লেনদেন করা যায়। ভারতে এখনও পর্যন্ত অপশন লেনদেন চালুর অনুমতি দেওয়া হয়নি।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন: নতুন বিলে অপশন লেনদেন চালুর অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে বাজারে ফিউচার এবং অপশন দুই ধরনের লেনদেনই চালু থাকবে। মনে রাখবেন, দু’য়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকির ধরন ও তার পরিমাণ এক্কেবারেই আলাদা।

লেনদেনের সময়সীমা
আগাম পণ্য লেনদেনে ন্যূনতম সময়সীমা ১১ দিন। অর্থাৎ, কোনও পণ্য কেনা বা বেচার জন্য চুক্তি করলে, সেটির ‘সত্যিকারের’ বেচা-কেনা করতে হবে অন্তত ১১ দিন পর।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন: নয়া বিলে এই ন্যূনতম সময়সীমা ৩০ দিন করার কথা বলা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে, লগ্নিকারীরা আরও বেশি সময় হাতে পাবেন। সুবিধা হবে দাম নির্ধারণেও।

শেয়ার বাজারে বিভিন্ন সংস্থার দর নিয়ে তৈরি ইনডেক্স বা সূচক রয়েছে। যেমন, বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) সেনসেক্স, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নিফ্টি ইত্যাদি। এগুলি দেখে বাজারের মতিগতি বোঝা সহজ হয়। আগাম পণ্যের বাজারে কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ ধরনের কোনও সূচক নেই।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন: নয়া বিল কার্যকর হলে, এক্সচেঞ্জগুলির সামনে কয়েকটি পণ্যের দর নিয়ে সূচক তৈরির সুযোগ থাকবে। ধরা যাক, রবি শস্য অথবা খরিফ শস্যের দর নিয়ে একটি ইনডেক্স বা সূচক তৈরি করা হল। লগ্নিকারীরা আলাদা ভাবে এক-একটি পণ্য না-কিনে, সেই ইনডেক্স-এও সরাসরি লগ্নি করতে পারবেন। অর্থাৎ রবি বা খরিফ শস্যের অনেকগুলি পণ্যে একসঙ্গে লগ্নির সুযোগ পাওয়া যাবে। এখন শেয়ারের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ রয়েছে।
এতে লগ্নিকারীদের কতখানি সুবিধা হবে, তা বলতে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ধরুন, খরার জন্য যদি বর্ষাকালে ফসল কম হয়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই খরিফ শস্যের দাম বাড়ে। লগ্নিকারী তখন সুবিধা বুঝে খরিফ শস্য নিয়ে তৈরি কোনও ইনডেক্স-এ বিনিয়োগ করতে পারবেন। এতে সাধারণ বাজারে বাড়ির হেঁসেলের জন্য হয়তো তাঁকে বেশি দাম দিয়ে সব্জি কিনতে হল। কিন্তু দেখা গেল, ইনডেক্স-এ দাম বাড়ার কারণে পণ্য বাজারে লাভবান হলেন লগ্নিকারী। তবে মনে রাখবেন, পণ্য বাজারে সূচক থেকে মুনাফা করতে পারেন, কিন্তু কেনা জিনিস বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না।

আইনের মারপ্যাঁচ
ভারতের আগাম পণ্য লেনদেনের বাজার ফরওয়ার্ড মার্কেটস কমিশন (এফএমসি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যার সদর দফতর মুম্বইয়ে।
১৯৫৪ সালের ফরওয়ার্ড কনট্র্যাক্ট রেগুলেশন অ্যাক্ট (এফসিআরএ) মেনে এই বাজার পরিচালিত হয়।
বর্তমান আইন অনুযায়ী প্রায় ১২০টি পণ্য এখানে কেনাবেচা হয়।
এফসিআরএ ছাড়াও আগাম লেনদেনের বাজার (বিশেষত পণ্য হাতে নেওয়া ইত্যাদি) বিক্রয় কর আইন, যুক্তমূল্য কর, অক্ট্রয়, বিমা আইন, কৃষি বিপণন আইন, হিমঘর আইন ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত।
এমসিএক্স, এনসিডিইএক্সের মতো এক্সচেঞ্জগুলিরও নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এক্সচেঞ্জ নিয়ম বদলায়। নতুন নিয়ম আনে। বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা লগ্নিকারীদের জানিয়ে দেওয়া হয়।
টাকা-পয়সা লেনদেন অথবা বিদেশের বাজারগুলির সঙ্গে ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে মানতে হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মও।
সমস্যা হলে কী ভাবে জানাবেন?
সাধারণত বিরোধ দেখা যায় লগ্নিকারী এবং এক্সচেঞ্জ সদস্যদের মধ্যে। লগ্নির অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও বিরোধ মেটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মানলেই সমস্যা সমাধানের জন্য আবেদন করতে পারবেন আপনি। সালিশির মাধ্যমে এই সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হয়।
প্রথমে এক্সচেঞ্জকে বিস্তারিত ভাবে সমস্যার কথা জানান। তা কোনও সদস্যের দুর্ব্যবহার, লগ্নিকারীকে না-জানিয়ে ভুল লেনদেন, বেআইনি লেনদেন, লগ্নিকারীকে লাভের অংশ না-দেওয়ার মতো অনেক কিছুই হতে পারে। সাধারণত এক্সচেঞ্জগুলিই সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
যেতে পারেন এফএমসি-তেও।
যে কোনও ভাষায় সমস্যার কথা লিখতে পারেন। চাইলে বাংলাতেও।
পাঠাতে পারেন ফ্যাক্স/ ই-মেল অথবা ডাক যোগে।
সমস্যার গভীরতা বিচার করে এক্সচেঞ্জগুলি।
সালিশির মাধ্যমে সুরাহা মিলতে সময় লাগে প্রায় ৪ মাস।
এক্সচেঞ্জের তালিকা থেকেই নিজের পছন্দের সালিশ বেছে নিতে পারেন।
৫ লক্ষ টাকার নীচে সালিশির জন্য সাধারণত পকেট থেকে খরচ করতে হয় না।
সমস্যার দিন থেকে তিন বছর পর্যন্ত আবেদন জানানো যেতে পারে।
সমস্যা জানানোর সময় সঠিক কাগজপত্র থাকা জরুরি। টাকা লেনদেন যে নগদে হয়নি, তার প্রমাণ, আবেদনপত্র ইত্যাদি গুছিয়ে রাখুন।
সমস্যা না-মিটলে বা সমাধান মনের মতো না-হলে যেতে পারেন আদালতেও।
কলকাতায় এমসিএক্স, এনসিডিইএক্সের মতো এক্সচেঞ্জগুলির সালিশি কেন্দ্র রয়েছে।
এফসিআরএ মেনেই এই বিরোধ মেটানো হয়।


লেখক এমসিএক্স স্টক এক্সচেঞ্জের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.