নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রোজ রোজ দাবি বা প্রতিবাদী মিটিং-মিছিলে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অনুরোধ-উপরোধে কাজ হচ্ছে না। অগত্যা ছাত্র ও শিক্ষাকর্মীদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে দিচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য সুরঞ্জন দাস মঙ্গলবার জানান, সিন্ডিকেটের পরের বৈঠকে এই ব্যাপারে আলোচনা হবে। তাঁর মতে, কারও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব না-করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এই আচরণবিধি জরুরি। যদিও শিক্ষাবন্ধু পরিবেশের জন্য শাস্তি নয়, সদিচ্ছার উপরেই ভরসা রাখতে চান তিনি।
ক্ষমতায় এসে শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করার কথা বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে শিক্ষা-প্রাঙ্গণে এখনও রাজনীতিরই রমরমা। শাসক দল ও বিরোধী পক্ষের পরিচিত কাজিয়া তো আছেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসক দলেরই দুই গোষ্ঠীতে খেয়োখেয়ি। যেমন, ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে তৃণমূল-সমর্থক এক দল কর্মীর হাতে মার খান দলেরই বর্ষীয়ান বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। |
সেই ঘটনার পরে কলকাতা পুরসভা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বেশ কিছু জায়গায় মৌনী মিছিল করেন শোভনদেব-অনুগামীরা। সোমবারেও এই ধরনের একটি মিছিল হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেও অনেকে সামিল হয়েছিলেন বলে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। সেই সময় আবার কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ক্লাস চলাকালীন তাঁদের সামনেই এই ধরনের মিছিলের জেরে ১৫৫ বছরের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের অনেকে। এই ধরনের ঘটনায় অতীতেও একাধিক বার বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে লজ্জিত হতে হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতেই ছাত্র ও শিক্ষাকর্মীদের জন্য আচরণবিধি তৈরির কথা জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, “কারও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্যও কিছু নিয়মবিধি মানতে হয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটি আদর্শ আচরণবিধি চালু করার পক্ষে। সিন্ডিকেটের বৈঠকে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করব।”
বিশ্ববিদ্যালয় এর আগেও আচরণবিধি চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ বারের পরিকল্পনারও যে একই হাল হবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
উপাচার্য বলেন, “উপর থেকে আইন চাপিয়ে আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করা যায় না। পুলিশ-নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়েও তা প্রয়োগ করা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে সংগঠন করা আর কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, সকলকেই সেটা বুঝতে হবে।” |
কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে নিত্যদিনের রাজনৈতিক চাপান-উতোরে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, সেখান থেকে পঠনপাঠন অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারলে ভাল হত বলে মনে করেন উপাচার্য। প্রশাসনিক ভবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে হয়তো পড়াশোনার পরিবেশ রক্ষা করা তুলনায় সহজ হত। কিন্তু বাস্তবে এখনই তা সম্ভব নয়। উপাচার্য বলেন, “ভবিষ্যতে কোনও উপাচার্য যদি পারেন, কলেজ স্ট্রিটের বিভাগগুলি অন্যত্র সরাবেন। কিন্তু এখনই তা হচ্ছে না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ভাবে পঠনপাঠন ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা যায়, সেই চেষ্টাই করতে হচ্ছে।” তাঁর মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র বা কর্মী সংগঠনের সদস্যদের একটা বিশেষ সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা দরকার। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই সংশ্লিষ্ট সকলে বিধি মেনে চলবেন বলে আশা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ।
রাজ্যে শিক্ষা-প্রাঙ্গণকে রাজনীতির মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যের আমলে তা চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু পালাবদলের পরেও যে বাম আমলের ঐতিহ্যে ছেদ পড়েনি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার প্রমাণ। যদিও এই ক্ষেত্রে বিবাদ বর্তমান শাসক দল তৃণমূলেরই দু’টি কর্মী সংগঠনের মধ্যে।
কিন্তু শুধু আচরণবিধি চালু করেই কি এই কর্মী-সংস্কৃতির ইতি ঘটানো যাবে? অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী তা মনে করেন না। তাঁর কথায়, “এর জন্য দরকার শুভবুদ্ধির। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে মিটিং-মিছিল করা যে ঠিক নয়, সেটা সবার আগে রাজনৈতিক নেতাদের বোঝা উচিত।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস থেকে ক্লাস সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যা বলেছেন, তাতে তাঁর অসহায়তাই ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন ওই প্রবীণ অধ্যাপক। বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহও মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলি সচেতন না-হলে এই প্রবণতা আটকানো যাবে না। তাঁর কথায়, “আমাদের অনেকেরই ক্ষীণ আশা ছিল, পরিবর্তনের ফলে হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির রমরমা কমবে। কিন্তু হচ্ছে উল্টো!” বর্ষীয়ান শিক্ষক সুনন্দ সান্যালও মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতি দূর না-হলে ক্যাম্পাসে হামলা, নিত্য মিটিং-মিছিল চলতেই থাকবে।
অবশ্য এ-যাত্রায় অভিযোগের আঙুল যাঁদের দিকে, তৃণমূলের সেই দু’টি কর্মচারী সংগঠনই আচরণবিধিকে স্বাগত জানিয়েছে। সিটু প্রভাবিত সংগঠনও ব্যতিক্রম নয়।
শোভনদেববাবুকে হেনস্থার ঘটনার তদন্তে এ দিন দুই সদস্যের কমিটি গড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক তথা সিন্ডিকেটের সদস্য সাধন দাশগুপ্ত এবং সিন্ডিকেটে উচ্চশিক্ষা সংসদের মনোনীত অরুণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে গঠিত ওই কমিটির ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা। স্থানীয় থানার কাছ থেকেও ওই দিনের ঘটনার বিবরণ চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-সব পুলিশকর্মী সর্বক্ষণ পাহারায় থাকেন, তাঁদের কেউ কেউ ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। |