বিচার-ব্যবস্থার প্রতি ‘বিরূপ মন্তব্য’ করায় রাজ্যের কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার ফৌজদারি মামলা শুরু করল কলকাতা হাইকোর্ট। মঙ্গলবার মামলার রুলিং দিয়ে হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিচারপতি সুবল বৈদ্যের ডিভিশন বেঞ্চ ১৮ ডিসেম্বর বেচারামবাবুকে কোর্টে তলব করেছে। সে দিন তাঁকে আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে, ওই মন্তব্যের জন্য কেন তাঁকে জেলে পাঠানো হবে না।
গত রবিবার সিঙ্গুরে এক জনসভায় বেচারামবাবু অভিযোগ করেছিলেন, টাটা-সিপিএম একজোট হয়ে এবং তাদের অনুগত বিচারককে দিয়ে সিঙ্গুরের জমি-মামলায় সরকারকে হারিয়ে দিয়েছে। মন্ত্রীর মুখে এ হেন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সোমবার আইনজীবী কল্লোল বসু প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আর্জি জানিয়েছিলেন, বেচারামবাবুর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার ফৌজদারি মামলা রুজু করুক হাইকোর্ট। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি তখন জানিয়ে দেন, তথ্য-সহ হাইকোর্টে আবেদন এলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। মঙ্গলবার তথ্য-সহ হাইকোর্টে দু’টি আবেদন জমা পড়ে। বেলা দু’টোয় মামলা শুরু হয়।
এ দিকে কয়েক দিন আগে বিধানসভায় এক অনুষ্ঠানে ‘টাকা দিয়ে বিচার কেনা হয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যার প্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার মামলা হয়েছিল। বিচারপতি কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানিও শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিচারপতি সেনগুপ্ত উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে বদলি হয়ে যাওয়ায় রায় দিয়ে যেতে পারেননি। সেই মামলাটির শুনানি ফের শুরু করার আর্জিও এ দিন হাইকোর্টে পেশ করেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। কোন ডিভিশন বেঞ্চে সেটির পুনরায় শুনানি হবে, আজ বুধবার প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ তা জানাবে। |
এ দিন বেচারামবাবুর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে প্রথম আবেদনকারীর কৌঁসুলি বিকাশবাবু আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান। বলেন, অন্যান্য সংবাদপত্রেও মন্ত্রীর একই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এবিপি আনন্দ ও আর একটি টিভি চ্যানেলেও তার সম্প্রচার হয়েছে, প্রয়োজনে যার সিডি হাইকোর্ট দেখতে পারে। “সরকারপক্ষ থেকে বার বার আদালতকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অনুগত বিচারক! হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ বিচারের আশায় আদালতে আসেন। ধনী লোকেরা অনুগত বিচারককে দিয়ে নিজেদের পক্ষে রায় নিতে পারেন, এমনই বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এতে আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমবে।” অভিযোগ করেন বিকাশবাবু। তাঁর বক্তব্য শুনে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি প্রতাপ রায়ের মন্তব্য, “সব দলই ক্ষমতায় থাকলে এমনই করে।” বিচারপতি রায় এ প্রসঙ্গে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর ‘লালা, বাংলা ছেড়ে পালা’ উক্তিটির উল্লেখ করেন। ওই উক্তির জন্য বিমানবাবুর বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার মামলা হয়েছিল। তদানীন্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় বিমানবাবুকে তিন দিনের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
গত রবিবার সিঙ্গুরে বেচারামবাবু আরও বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তাঁরা আন্দোলনে নামবেন। যাকে আদালতের রায় না-মানার হুমকি হিসেবেই দেখছেন সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী। বিচারপতি রায়ের মন্তব্য স্মরণ করানো হলে শ্যামলবাবু বলেন, “আদালতের রায় মানব না এমন ভয়ঙ্কর কথা আমরা কোনও দিন বলিনি।”
এ দিন বিকাশবাবু দাবি করেন, হাইকোর্টে যা তথ্য জমা পড়েছে, স্বতঃপ্রণোদিত আদালত অবমাননার রুল জারি করার পক্ষে তা যথেষ্ট। তাঁর যুক্তি, প্রয়াত সিপিএম নেতা ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের লেখা একটি দার্শনিক প্রবন্ধের ভিত্তিতে হাইকোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছিল। হাইকোর্ট মনে করলে বেচারামবাবুর ক্ষেত্রেও স্বতঃপ্রণোদিত ফৌজদারি মামলা হতে পারে বলে সওয়াল করেন বিকাশবাবু। অপর আবেদনকারীর কৌঁসুলি রবিলাল মৈত্রের মতে, “কনটেম্পট অফ কোর্ট অ্যাক্টের ১৫ নম্বর ধারা মোতাবেক হাইকোর্ট চাইলে কোনও আবেদন ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত আদালত অবমাননার মামলা শুরু করতে পারে। এমন নজির বহু রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টেও হয়েছে।”
সওয়াল শুনে এবং বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি বলেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, বেচারামবাবুর বক্তব্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিচার-ব্যবস্থার কুৎসা করা হয়েছে।” এর পরে বেচারামবাবুর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালত অবমাননা মামলার রুলিং দিয়ে তিনি জানিয়ে দেন, আনন্দবাজার-সহ তিনটি বাংলা সংবাদপত্র ও দু’টি টিভি চ্যানেলকে এ ব্যাপারে হলফনামা দিতে হবে। ঘটনার দিন কোন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে ছিলেন ও তিনি নোটবুকে কী লিখেছেন, তা জানিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি-সহ জমা দিতে হবে সেই হলফনামা। টিভি চ্যানেলকে হলফনামার সঙ্গে সিডি জমা দিতে হবে।
আদালত অবমাননার ফৌজদারি মামলা মানে কী?
আইনজীবী মহলের ব্যাখ্যা: মানহানির মামলা দু’রকম দেওয়ানি ও ফৌজদারি। ফৌজদারিতে দোষী সাব্যস্ত হলে কারাদণ্ড হয়। দেওয়ানিতে জরিমানা। আদালত অবমাননার দেওয়ানি মামলা যে কেউ দাখিল করতে পারেন। ফৌজদারির ক্ষেত্রে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের অনুমতি নিতে হয়। তবে হাইকোর্ট চাইলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফৌজদারি অবমাননা-মামলা চালু করতে পারে, সেটা পুরোপুরি হাইকোর্টের বিবেচ্য।
এবং বেচারামবাবুর ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। যদিও হাইকোর্টের এ দিনের রুলিং প্রসঙ্গে বেচারামবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। মহাকরণে তিনি বলেন, “এই চেয়ারে বসে এ নিয়ে কোনও কথা বলব না। আদালতের নির্দেশ এখনও আমার কাছে পৌঁছয়নি।” দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে কি?
সে সম্পর্কেও মুখ খোলেননি কৃষি প্রতিমন্ত্রী। উল্লেখ্য, বেচারামবাবুর বিরুদ্ধে বিধানসভায় স্বাধিকারভঙ্গের নোটিসও জমা দিয়েছেন সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তার কী হবে?
বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “আইনে যা আছে, তা-ই হবে। আগামী সোমবার বিষয়টি সভায় পেশ করা হবে। তার পরে বিধিমাফিক সিদ্ধান্ত হবে।” পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বেচারামবাবু ঠিক কী বলেছেন, জানি না। সংবাদমাধ্যম দেখে সিদ্ধান্তে আসতে চাই না। তবে যা বলেছেন, সভার বাইরে।” পার্থবাবুর এ-ও দাবি, “বাম জমানায় বিরোধী হিসেবে আমাদের দেওয়া এমন অনেক স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব তৎকালীন স্পিকার (হাসিম আব্দুল হালিম) নাকচ করে দিয়েছেন।” মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোর্টের এই রুলিং বিরোধীদের বাড়তি হাতিয়ার জোগাবে কি না, সে প্রশ্ন করা হলে পার্থবাবুর মন্তব্য, “আদালত আদালত। এটা বিধানসভা।” |