|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আমাদের সর্বত্র বড় বেশি চালাক লোক |
চালাকরা নিজের জীবনে খুব উন্নতি করতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই অন্য মানুষ,
পাটোয়ারি বুদ্ধি যাকে ‘বোকা’ বলবে। বাঙালির সমাজে তার ঘোর অনটন,
তাই আমরা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি না, রাখতেও পারি না।
বাসব চৌধুরী |
কেরিয়ার কথাটা খুব পরিচিত। কিন্ডারগার্টেন থেকেই কেরিয়ার গড়ার প্রয়াস শুরু হয় এখন। বাচ্চারা জানে কী হতে হবে, কোন পরীক্ষা দিতে হবে। বাচ্চাদের থেকে তাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন অনেক বেশি করে জানেন জয়েন্ট এন্ট্রান্স, স্যাট, ম্যাট, কাট-এর কথা। জুতসই একটা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে, তার পর একটি লাইনে প্রবেশ করতে পারলে খানিকটা নিশ্চিন্ত-বোধ, মানসিক প্রশান্তি হয় সকলেরই। তার পর একটি চাকরি পাওয়া অথবা বিদেশে চলে যাওয়া এটুকু হলে খানিকটা পা-ছড়িয়ে বসার বোধ হয়।
আমরা বাঙালিরা চাকরি করতে ভালবাসি। চাকরির মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে কেরিয়ার গড়তে ভালবাসি। আমাদের দেশে অন্যান্য রাজ্যে বা অন্যান্য দেশেও মানুষ কেরিয়ার গড়েন। কিন্তু আমাদের, মানে বাঙালিদের কেরিয়ার গড়াটা অন্যান্যদের কেরিয়ার গড়ার থেকে খানিকটা ভিন্ন প্রকৃতির। জীবনে এগিয়ে চলার পথে আমরা সফল বাঙালিরা বেশ অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক। এবং যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেই প্রতিষ্ঠানের মান-সম্মান-প্রতিষ্ঠা-পরিচিতি এবং আমজনতার মনে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এক বিশেষ সম্ভ্রম বোধ তৈরি করার ব্যাপারে আমরা প্রায়শই নিতান্ত উদাসীন। |
|
গর্বের প্রতিষ্ঠান। আই এস আই’তে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। ১৯৫৪ |
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি কোনও একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সে প্রতিষ্ঠান মহাকরণও হতে পারে, পুরসভাও হতে পারে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে পারে, হাসপাতালও হতে পারে, বেসরকারি সংস্থাও হতে পারে। এ-ও ধরে নেওয়া যাক যে, আপনার কর্মজীবনের শুরুও হয়েছিল ওই প্রতিষ্ঠানেই। আপনি চাকরিজীবনে বেশ সফল, পাড়ায় এবং সমাজে আপনার যথেষ্ট নামডাক এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি। কিন্তু আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আপনার পাড়ার লোকদেরও বিশেষ আস্থা নেই। এমন অবস্থায় আপনার কেমন অনুভূতি হয়? মনে হয় কি যে, আপনি যথেষ্ট সফল হলেও আপনার প্রতিষ্ঠান সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে বা হচ্ছে! আপনি কি তা নিয়ে ভাবেন? না কি, আপনি নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য ও প্রতিপত্তি নিয়েই সন্তুষ্ট, আপনার প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নিয়ে আপনার বিশেষ মাথাব্যথা নেই? যদি থাকে, তবে আপনাকে অভিবাদন জানাই, ব্যতিক্রমী মানুষকে অভিবাদন জানানোই তো উচিত। উপরে উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠানেই ঝকঝকে কেরিয়ার-সর্বস্ব অনেক মানুষ রয়েছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলি অধিকাংশই কেমন যেন ধুঁকছে, তারা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের গৌরবময় জায়গা কিছুতেই করে নিতে পারছে না।
|
তে হি নো দিবসাঃ |
যখন ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন কলকাতা শহরের হিন্দু ইস্কুল, হেয়ার, বেথুন ইত্যাদি ইস্কুলের খুব নামডাক ছিল। একাদশ শ্রেণির পরে যে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হত, সেই পরীক্ষায় এই সব ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা খুব ভাল ফল করত ধারাবাহিক ভাবে। এ ভাবে ইস্কুলগুলি প্রতিষ্ঠানের চেহারা পেয়েছিল, সম্মান পেয়েছিল। বর্তমানে এ সব ইস্কুলের নাম বিশেষ শোনা যায় না। কারণটা কী? উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই? না কি, সবই আছে, কিন্তু যা আছে, তাতে প্রতিষ্ঠান গড়ার রসদ নেই। বোলচাল দিয়ে, স্ট্যাটিস্টিকস দিয়ে অন্য রকম প্রমাণ করার যতই চেষ্টা হোক না কেন, দুর্ভাগ্যজনক সত্যটা এই যে, আমরা বাঙালিরা প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যর্থ হয়েছি।
আমাদের এই অক্ষমতার দুটো দিক। এক, বড় বড় প্রতিষ্ঠান যা-কিছু ছিল আমাদের, সে সব আমরা অবহেলা করে নষ্ট করে ফেলেছি, এবং দুই, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়তে পারিনি। এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাব যা হয়েছে, তা হল, আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের সুনাম এবং সম্মান হারিয়ে ফেলেছে। অথচ বাঙালির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখছে না এমন নয়। অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখছে; নেট, সেট, স্লেট, ক্যাট, ম্যাট, স্যাট পাশ করছে, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির কনসুলেটসমূহে লাইন দিচ্ছে, বিদেশে যাচ্ছে এই সবই হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতা এবং অন্যান্য শহরে প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ছে না।
সেই কবে ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার ২০-২২ বছর আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ২০-২২ বছর পর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী কালে বোস ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, বিশ্বভারতী ইত্যাদি সব নাম করা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রয়াসের ফলে। আমাদের দেশ স্বাধীনতা পায় ১৯৪৭ সালে। তার পর থেকে কলকাতা শহরে নাম করা কতগুলি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে ভেবে দেখুন তো! যে ক’টি হয়েছে, সেগুলিও ব্যক্তিগত মালিকানার মুদির দোকানের মতন, যেখানে মালিক বা সৃষ্টিকর্তা বা প্রভু তাঁর সহকর্মীদের ভৃত্যসম মনে করেন বা করেছেন, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান কৈশোর পেরোনোর আগেই পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছে।
গত দশ-পনেরো বছরে আমাদের রাজ্যে বেশ অনেকগুলি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এই প্রতিষ্ঠানসমূহ কেমন আছে? তারা যে সব ভাল আছে, বাতাস তো আমাদের কানে এমন কথা পৌঁছে দেয় না। প্রতিষ্ঠানসমূহে চালকের আসনে যাঁরা আছেন, তাঁরা সুশিক্ষিত নন, এমনটিও বলা যাবে না। তা হলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারছি না কেন? কারণটি বোধ হয় আমাদের অক্ষমতা, এবং স্রেফ অক্ষমতা। ছিদ্রান্বেষণ করে, কাঁকড়ার মতো অগ্রবর্তী কাউকে পেছনে টেনে ধরে কোনও জাতি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারেনি, পারবে না। ওপরচালাকি দিয়ে, বোলচাল দিয়ে, তেলা মাথায় তেল দিয়েও প্রতিষ্ঠান গড়া যাবে না। প্রতিষ্ঠান গড়তে গেলে কর্মজগতে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে আখের গুছিয়ে নেওয়া, অথবা অন্যকে দোষ দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে এগিয়ে যাওয়া যেতেই পারে। তাতে বেশ সাজানো-গোছানো একটা কেরিয়ারও তৈরি হতে পারে। কিন্তু সমাজের প্রয়োজনে যেমন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, কেরিয়ারসর্বস্ব ম্যানেজার দ্বারা তা হবার নয়। কর্মের সর্বজগতে এই প্রিন্সিপল বা নীতিটি সত্য। যাঁরা গড়তে চাইছেন বা গড়তে চেষ্টা করছেন, তাঁদের এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।
|
বায়ো ডেটা ছাড়িয়ে |
বিজ্ঞানের জগতেও এই নীতিটি সত্য। বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান মানে ঝাঁ-চকচকে বাড়িঘর, গ্লেজড টাইলে মোড়া মেঝে, স্যুট-বুট পরা বিজ্ঞানী, নতুন রঙের গন্ধ বেরনো বা মেড ইন ইউ এস এ বা জার্মানি লেখা যন্ত্রপাতি, পাতার পর পাতা ধরে লেখা প্রজেক্ট ওয়ার্কের বিবরণ নয়। বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিশ্বের দরবারে জায়গা করে নিতে হলে বিশ্বমানের বৈজ্ঞানিক ফলাফল উৎপাদন করতে হবে, প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। নচেৎ আমজনতা বিজ্ঞানের প্রতি, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিক ভাবে শ্রদ্ধাশীল হবে না। সিনিয়র বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে সময় না কাটিয়ে যদি অধিকাংশ সময় আকাশে বিচরণ করেন, তবে তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা এবং জুনিয়র বিজ্ঞানীরা অগ্রজদের অনুসরণ করবেন, শস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা করবেন। এই সব করে তাঁদের লম্বা-চওড়া বায়োডাটা হবে, কেরিয়ার হবে; কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানসমূহে তাঁরা কাজ করেন, সেগুলির অন্দরমহল শক্তপোক্ত হবে না।
কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সরকার নানা রকম প্রতিষ্ঠান গড়বার জন্য অর্থ বরাদ্দ করছে। শুধু বিলেত-ফেরত লোক দিয়ে এই সব প্রতিষ্ঠান গড়া যাবে না। যা প্রয়োজন, তা হল, কমিটমেন্ট। রক্ত-অশ্রু-ঘাম ঝরাতে ইচ্ছুক এবং সুশিক্ষিত কিছু মানুষ আমাদের দরকার, যাঁরা ওপরচালাকি হবেন না এবং বেশির ভাগ সময়টা প্রতিষ্ঠান-নির্মাণে ব্যয় করবেন। তাঁদের মনে এক ধরনের প্রফেশনালিজম থাকতে হবে। বোলচাল নয়, সত্যিকারের প্রফেশনালিজম।
আমরা বড় বেশি কথা বলি। সেটাকেই স্মার্টনেস মনে করি। আমাদের দেশের অফিস-কাছারিতে যে-সব কর্মী মন দিয়ে, সময় দিয়ে কাজ করেন, আমরা অনেক সময় তাঁদের ‘গাধা’ বলে ব্যঙ্গ করি। আর যাঁরা বড় বড় কথা বলেন, বস-কে সন্তুষ্ট করে রাখেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু করেন না, তাঁদের বলি ‘চালাক’ লোক। আমাদের সমস্যা হল, নিচুতলা থেকে উপরতলা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে চালাক লোকের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, যা মহামারি রূপ ধারণ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিনাশ করছে। আমাদের প্রয়োজন মনের অভ্যন্তরে স্থিত চালাক লোকটিকে চাবুক মেরে তাকে খানিকটা ‘গাধা’ বানানোর।
|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|