তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটি লইয়া সংগত কারণেই কথা উঠিয়াছে। কম্পিউটার বা সমজাতীয় কোনও যন্ত্রের সাহায্যে কারও বিরুদ্ধে কোনও অপমানজনক, মানহানিকর, প্ররোচনামূলক কিছু সম্প্রচার করিলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই এই ধারা। আইন বিশারদরা বলিতেছেন এই ধারাটি রচনার সময় সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা আমেরিকা ও ইংল্যন্ডে প্রচলিত তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক আইন সামনে রাখিয়া নিতান্ত ‘নকল’ করিয়াছেন। কিছুই প্রায় ভাবনাচিন্তা করেন নাই। ধারাটি কী ভাবে কতটা বদলাইতে হইবে এবং প্রয়োগ করিবার সময় কী কী সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যিক তাহা লইয়া আলোচনা চলিতেছে। উত্তম আইনের ফাঁক ও তাহা প্রয়োগের ত্রুটি বন্ধ করা আবশ্যক, সন্দেহ নাই। কিন্তু এই উপলক্ষে অন্য একটি প্রশ্ন ওঠে। ‘অপমান’, ‘মানহানি’ ইত্যাদির সংজ্ঞা এবং ভাবার্থের প্রশ্ন। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলি লইয়া কথা চলিতেছে তাহা তো নিতান্তই রাজনীতিবিদদের মান-অপমান সংক্রান্ত। সেই সূত্রেই প্রশ্নটি ওঠে।
মান অপমান কাহাকে বলে? কেহ যদি কাহাকে অপমান করে, গালিগালাজ করে তাহা হইলে যে করিতেছে সে তো তাহার দীনতা। সমাজ-সংসারে মানুষ এমন নির্বোধ নহে যে যিনি অপমানিত হইতেছেন তাঁহাকে অধম ভাবিবেন। কাজেই অপমান গায়ে না মাখিলেই হইল। এহ বাহ্য। যাঁহারা সুপরিচিত নেতা বা বিশিষ্ট মানুষ তাঁদের ক্ষেত্রে মান অপমানের প্রশ্নটি বৃহত্তর। হারুন-অল-রশিদ নাকি সাধারণের ছদ্মবেশে তাঁহার রাজ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। উদ্দেশ্য, প্রকাশ্যে তো ভয়ে রাজার নামে কেউ খারাপ কথা বলিবে না, ছদ্মবেশে থাকিয়া সেই কুকথা শুনিয়া রাজা রশিদ আত্মসংশোধনের চেষ্টা করিবেন। অপমানিত তো হইবেনই না, বরং সেই নিন্দাসূচক কথার মধ্যে যদি সারকথা কিছু থাকে তাহা সাদরে গ্রহণ করিবেন। শেক্সপিয়রের নাটকে ভাঁড়েরা নানা অতিরঞ্জিত আপাত কটু ব্যঙ্গাত্মক কথা বলিয়া থাকেন। সে কথাগুলিতে প্রকৃত রাজা অপমানিত হন না। নিজের ভুল শুধরাইয়া লইবার চেষ্টা করেন। এই বিনয়ই তো প্রকৃত শাসকদের নিকট হইতে কাম্য। শুধু শাসক কেন, জনগণের সহিত যে বিশিষ্টজনেরা যোগ রাখিতে তৎপর তাঁহারা তো এই সংশোধনী বিনয়ের অধিকারী। উদাহরণ চৈতন্যদেব। আঘাত করিলেও আহত হইতেন না। এই ‘বৈষ্ণব বিনয়’কেই তো সম্প্রসারিত অর্থে গাঁধী তাঁহার অহিংসার রাজনীতিতে প্রয়োগ করিয়াছিলেন। রাজনীতির ভুল ঠিকের বিচার অন্য কিন্তু আপাতবিরোধী কথা বা অপমানকে গ্রহণ করিবার সাহস যাঁহার বা যে দলের নাই তাঁহাদের গণতন্ত্রে রাজ করিবার অধিকার নাই। অহমিকাশূন্য মাটির মানুষ না হইলে সাধারণের কাছে যাওয়া যায় না। কেবল স্লোগান তুলিলে কিছু হইবার নহে। গণতন্ত্র স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারীদের আজ না হউক কাল ভ্যানিশ করিয়া দেয়। মৃত্যুর পর কাহারও অবদান লইয়া প্রশ্ন তুলিলেই যদি দলের শাগরেদরা অপমানিত হন এবং রে রে করিয়া ওঠেন তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তাঁহার প্রতি ভক্তি নিতান্তই ঠুনকো। আজ না হোক কাল ভাঙিবে। |