গুজরাত রাজ্যটির নামোল্লেখমাত্র মতামতের দুইটি বিপরীতবাহিনী স্রোত বহিতে আরম্ভ করে। এক দলের নিকট গুজরাত হইল ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শেষ দুর্গ। অপর দলের মতে, গুজরাত ভারতের উন্নয়ন রাজধানী। বাস্তব স্বভাবতই দুই চরমপন্থী মতের মধ্যবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত। এবং, বাস্তব স্থাণু নহে, জঙ্গম। গুজরাতের ক্ষেত্রে বাস্তবের গতি ক্রমেই প্রথম প্রবাহ হইতে দ্বিতীয়টির দিকে। নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতি যে ক্রমেই মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ হিন্দুত্ব হইতে ‘গুজরাতি অস্মিতা’র পথ পার হইয়া একবিংশ শতকের উন্নয়নের ভাষ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তাহা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টি গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্তেহার প্রকাশ করিল। তাহাকে ‘নরেন্দ্র মোদীর ইশ্তেহার’ বলিলে নাগপুরেও কেহ অসন্তুষ্ট হইবেন না। সেই ইশ্তেহারে বহু প্রসঙ্গ রহিয়াছে, কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্ব পাইয়াছে ‘নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি’-র কথা। গোটা দেশের রাজনীতি যখন ‘আম আদমি’ লইয়া মশগুল, তখন নরেন্দ্র মোদী কেন নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির দিকে তাকাইলেন, তাহার উত্তর গুজরাতের জনচিত্রে রহিয়াছে। সেই রাজ্যে নগরায়ণের হার সর্বভারতীয় গড়ের বহু ঊর্ধ্বে রাজ্যের ৪৩ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করেন। মোদীর প্রধান ভোটব্যাঙ্কও এই নাগরিকরাই। এই জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, গুজরাতের শিল্পোন্নয়নের কল্যাণে, ক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করিতেছেন। তাঁহারাই নব্য মধ্যবিত্ত। নরেন্দ্র মোদী বলিয়াছেন, এই শ্রেণিকে বৃদ্ধির উচ্চতর কক্ষে প্রেরণ করিতে যে ধাক্কার প্রয়োজন, তাহার ব্যবস্থা করাই এই দফায় তাঁহার লক্ষ্য।
মোদীর ‘নব্য মধ্যবিত্ত’-প্রীতিতে নিঃসন্দেহে ভোটের রাজনীতি আছে। কিন্তু তাহাতে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবটি ঢাকা পড়ে না। অর্থনৈতিক সংস্কারোত্তর ভারতেই এই শ্রেণির জন্ম। তাহাদের সংকট আছে, লড়াই আছে, বিশ্বায়িত দুনিয়ায় টিকিয়া থাকিবার জন্য নিত্যনূতন পথের সন্ধান করিবার বাধ্যবাধকতা আছে কিন্তু একই সঙ্গে বড় হইবার, খুলিয়া বাঁচিবার অদম্য ইচ্ছাটিও আছে। রাজনীতির ভাষ্যে এই শ্রেণিকে ধরা কঠিন। আম আদমি অনেক সহজ বিকল্প, কারণ তাহারা অনন্ত কাল হইতে ভারতেই আছে। তাহাদের কৃষি অর্থনীতি ভারতের চেনা, তাহাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা অথবা অফিসের কনিষ্ঠ করণিক হওয়াও। এই শ্রেণির কথা বলিতে বিশেষ কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয় না। এবং এই শ্রেণিটি কোথায়, তাহা দেখিতেও চেষ্টা করিতে হয় না। ফলে সনিয়া গাঁধী হইতে প্রকাশ কারাট, নীতীশ কুমার হইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং অধুনা অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রত্যেকেই ‘আম আদমি’-র কথাকেই তাঁহাদের রাজনীতির ধ্রুবপদ জ্ঞান করিয়াছেন। নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি তুলনায় কম দৃষ্টিগোচর হয়। বহু রাজ্যে, যেমন পশ্চিমবঙ্গে, তাহাদের ভোটশক্তিও তেমন নহে। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার রাজ্যের জনচিত্রের কল্যাণে এই শ্রেণিকে দেখিয়াছেন, তাহাদের কথাকে নিজের রাজনৈতিক ভাষ্যে আনিয়াছেন। অনুমান, দুই দশক পরে এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে থাকিবে।
কথাটি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সত্য হইবে কি না, তাহা অবশ্য অনুমান করা কঠিন। রাজনীতির কেন্দ্রে আসিতে হইলে শ্রেণিটিকে সংখ্যায় এবং উন্নয়নের বেগে তাৎপর্যপূর্ণ হইয়া উঠিতে হয়। আর তাহা তখনই সম্ভব, যখন রাজ্যে শিল্পোন্নয়নের পরিবেশ তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন কোনও ধারার উন্নয়নেরই পরিবেশ নাই। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান শাসককুল যদি উন্নয়নের পথে হাঁটিতে সিদ্ধান্ত করেনও, তাহা মূলত ‘আম আদমি’-র উন্নয়ন। দুই ধারার ফারাকটি স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন আম আদমির উন্নয়ন মূলত স্থিতাবস্থা বজায় রাখিবার প্রক্রিয়া, বড় জোর ধীর গতিতে অগ্রসর হওয়া; নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্নয়নের মধ্যে বেগই মূল কথা। প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশাসক নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে পার্থক্য এক জন শিল্পকে জমি ছাড়িতে নারাজ আর অন্য জন শিল্পের জন্য যে কোনও দূরত্ব হাঁটিতে প্রস্তুত। দৃষ্টিভঙ্গির এই ফারাক দুই রাজ্যে দুই ধারার উন্নয়নের বাস্তব সৃষ্টি করিতে পারে। তাহা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সুসংবাদ নহে। |