লোবায় এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশি অভিযানকে ঘিরে সংঘর্ষের ২৮ দিনের মাথায়। সভা করলেন। বললেন, লোবায় যা হয়েছে, তা অন্যায়। জানিয়ে দিলেন, সরকার জোর করে জমি নেবে না। সরকার শিল্পসংস্থা এবং গ্রামবাসীর মধ্যে আলোচনার জন্য ‘দালালি’ও করবে না।
দিনের শেষে লোবার কিন্তু প্রশ্ন, “শিল্পসংস্থা সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলছে না। সরকারও মধ্যস্থতা করবে না। তা হলে জমির ন্যায্য দাম ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসনের যে দাবি আমরা করছি, সে সবের কী হবে? সরকার মাঝখানে না থাকলে, জমির দালালদেরই বা কে ঠেকাবে?”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আর এলাকার মানুষের চাহিদার মধ্যে ফারাকটা স্পষ্ট। যেমন ফারাক থেকে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থল এবং লোবায় জমি-আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ধর্নামঞ্চের। সেই মঞ্চ থেকে মাত্র চারশো মিটার দূরেই একটি স্কুলের মাঠে মঙ্গলবার বিকেলে সভা করেন মমতা। ধর্নামঞ্চের পাশ দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে যাওয়া ও ফেরা, অথচ কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করা, নিজের মিনিট কুড়ির বক্তৃতায় কমিটির নাম একবারও মুখে না আনা ফারাক কি আরও স্পষ্ট নয়? |
প্রশ্ন থেকেই গেল। অথচ এ দিন লোবায় সভা করার কথা ছিল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। বাঁকুড়া সফর থেকে হঠাৎই মমতা চলে আসেন লোবায়। তা জেনে এলাকার মানুষের আশা ছিল, খনি প্রকল্প গড়ে আসা সংস্থার সরাসরি জমি নেওয়াকে ঘিরে যে জটিলতা এত বছর ধরে চলছে, তার হয়তো কোনও সুরাহা তাঁরা শুনতে পাবেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। কিন্তু, সরকার মধ্যস্থতা করবে না শুনে লোবার মানুষের একটা বড় অংশই হতাশ। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সভাপতি ফেলারাম মণ্ডল বা নেতা আশিস মিশ্র বলেন, “আশা করেছিলাম, উনি আমাদের মঞ্চে আসবেন। সেটা হল না। এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাদা করে মুখ্যমন্ত্রী কথাও বললেন না। ওঁকে দেব বলে স্মারকলিপি তৈরি রেখেছিলাম। সেটাও দেওয়া হল না।”
গত ৬ নভেম্বর লোবায় পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে আহত ৬ জন গ্রামবাসীর পরিবারের জন্য (এলাকার মানুষের দাবি, পুলিশের গুলিতে আহত) ক্ষতিপূরণ বাবদ মাথাপিছু ২৫ হাজার টাকার চেক সঙ্গেই এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চ থেকেই তিনি জানতে চান, “কেউ কি আছেন এখানে?” কোনও সাড়া আসেনি। মুখ্যমন্ত্রী ওই চেকগুলি পুলিশ সুপারের হাতে দিয়ে ৬টি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেন। ঘটনাচক্রে, আহতদের কিছু আত্মীয় তখন রয়েছেন অদূরেই, কমিটির ধর্নামঞ্চে। ব্যবধান এখানেও। |
এ দিনের সভায় মমতা বলেন, “জমি আপনাদের। আপনারা যা চাইবেন হবে। জমি বিক্রি করবেন না চাষ করবেন, সেটা পুরোপুরি আপনাদের অধিকার। কেউ কারখানা করলে, আপনারা যদি তাদের শর্তে রাজি থাকেন, তবেই জমি বিক্রি করবেন। কেউ দালালি করতে এলে সরাসরি ডিএমের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাতেও কাজ না হলে আমার কাছে খবর পাঠান।” এর পরেই তাঁর মন্তব্য, “কারও হয়ে সরকার দালালি বা মধ্যস্থতা করবে না।” যা শুনে লোবা ও সংলগ্ন গ্রামগুলির অনেক বাসিন্দারই প্রতিক্রিয়া, “আমরা হতাশ। সরকার হস্তক্ষেপ না করলে আমাদের মূল সমস্যার সমাধান কী করে হবে?”
কমিটির আন্দোলনের সহযোগী দল পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর এই আচরণে লোবার আন্দোলন আরও তীব্র হবে।” আন্দোলন হচ্ছেও। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এ দিনই সিউড়িতে জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে জনসভা করে বিক্ষোভ দেখায় কমিটি। ২৩ ডিসেম্বর মহাকরণের সামনে আন্দোলনের ঘোষণাও করেছে তারা। কমিটির আরও দাবি, এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আসা লোকজনের অধিকাংশই বাইরে থেকে এসেছেন। যদিও বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য, “সবাই দেখেছে, গ্রামের মেঠো পথ ধরে পুরুষ-মহিলারা সভায় আসছেন।”
বিকেল সাড়ে ৫টা। অন্ধকার নেমেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় হুশ করে বেরিয়ে গেল কমিটির ধর্নামঞ্চকে পাশে রেখে। পিছনে পড়ে রইল লোবা। ফারাকের সাক্ষী হয়ে। |