মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন শুনে মঞ্চে থাকা এক তৃণমূল নেতার জবাব, “না।” মঞ্চের নীচে থাকা পুলিশ সুপার কিন্তু বলছেন, “হ্যা।” মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, “কার কথা বিশ্বাস করব?” এমনটাই ঘটল মঙ্গলবার। দুবরাজপুরের লোবায় প্রকাশ্য জনসভায়।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, লোবার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুবরাজপুর থানার ওসি অর্ণব গুহকে সরানো হয়েছে কি না। পুলিশ সুপার হ্যাঁ বললেও অর্ণববাবু নিজেও সে কথা জানতেন না। এ দিন তিনি ব্যস্ত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সভায় ভিড় সামলাতে।
|
অর্ণব গুহ |
৬ নভেম্বর লোবায় জনতা-পুলিশ সংঘর্ষের পরেই সরানো হয়েছিল জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার হৃষীকেশ মিনাকে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংঘর্ষের দিন ‘পুলিশ সংযত ছিল’ বলে মন্তব্য করার পরেও কেন ওই বদলি হল, তা নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছিল পুলিশ মহলে। এ দিনের সভায় মুখ্যমন্ত্রী তিন মাস আগে দুবরাজপুরের দায়িত্ব নেওয়া ওসি অর্ণব গুহকে সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা যে ভাবে করেছেন, তাতে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
প্রথমত, বীরভূমের এসপি-কে সরিয়ে দেওয়ার কথা এর আগে মহাকরণে নিজেই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু দুবরাজপুরের ওসি-কে সরিয়ে দেওয়ার কথা এত দিন পুলিশ বা প্রশাসনিক কোনও স্তরে কখনওই জানানো হয়নি। সে ক্ষেত্রে প্রকাশ্য সভায় এ ভাবে ওসি-কে সরানোর কথা কেন বলতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে, প্রশ্ন তুলেছে রাজ্য পুলিশেরই একাংশ। দ্বিতীয়ত, সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসারদের অন্যতম ছিলেন অর্ণববাবুই। মমতা সভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি ওই এলাকায় বেশ কিছু ক্ষণ ছিলেন। |
খোলামুখ খনি প্রকল্পের জন্য জমি জোগাড় নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত লোবায়। প্রকল্প গড়ার কথা যে শিল্পসংস্থার, সেই ডিভিসি-এমটা’র মাটি কাটার যন্ত্র দীর্ঘদিন আটকে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই যন্ত্র উদ্ধার করতে গিয়েই গ্রামবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে গুলি চালায় পুলিশ। তা নিয়ে ইতিমধ্যেই এক প্রস্ত অস্বস্তিতে পড়েছে প্রশাসন। এ দিন তারা নতুন বিতর্কের মুখে।
এ দিন বিকেলে লোবার সভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, “থানার ওসি ‘চেঞ্জ’ হয়েছে এখানকার?” সভামঞ্চে থাকা তৃণমূল নেতাদের মধ্যে কেউ বলে ওঠেন, “না হয়নি।” সেই শুনে মমতার প্রশ্ন, “হয়নি এখনও? থানার ওসি-কে তো চেঞ্জ করতে বলে দিয়েছি।” বীরভূমের নতুন এসপি মুরলীধর শর্মা তড়িঘড়ি মঞ্চের নীচ থেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, ওসি-কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কার কথা বিশ্বাস করবেন, তা নিয়ে এক মুহূর্তের ‘ধন্দ’। ভিড়ের দিকে ফিরে মমতা পরে বলেন, “অলরেডি চেঞ্জ হয়েছে। এসপি আমাকে বলছেন। আমি তো ‘ইনস্ট্রাকশন’ দিয়ে দিয়েছিলাম।”
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ এসপি-কে ফোন করে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আপনি একটু পরে ফোন করুন।” ফোন কেটে দেন তিনি। রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ফের ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে চাননি। আর ‘সরিয়ে দেওয়া’ ওসি অর্ণব গুহর বক্তব্য, “সভাস্থল থেকে অনেকটা দূরে ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা দেখছিলাম। সভার কথাবার্তা শুনিনি। তবে আমাকে কেউ কিছু জানাননি।” স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের ঘটনা কি পুলিশকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরাবে না, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুলিশমন্ত্রী? |
বীরভূমের একাধিক পুলিশ অফিসার বলছেন, “বদলির চাকরি। যেখানে সরকার পাঠাবে, সেখানেই যেতে হবে। কিন্তু এ ভাবে প্রকাশ্যে সরিয়ে দেওয়ার কথা বললে সম্মানে লাগে। যারা কাজ করে, তাদেরই ভুল হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক স্তরে জানালে ভাল হত।” তাঁদের এ-ও প্রশ্ন, “দুবরাজপুরের ওসি-কে যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা কি আগে জানতেন আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ? না কি মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার চাপে পড়ে এসপি-কে সে কথা বলতে হল?”
জবাব জানার উপায় নেই। মুখে যে কুলুপ এঁটেছেন পুলিশ-কর্তারা। |