রোমান কলোসিয়ামের চেয়েও বেশি আবেগ মাঠটাতে
মরা যে যেখানে থাকি হয়তো কখনওই সেখানকার প্রশংসা করে উঠতে পারি না বরং তাকে অনেকটাই ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ হিসাবে ধরে নিই। যেমন, প্যারিসের লোকজন আইফেল টাওয়ার-এ ওঠার আগ্রহই দেখায় না।
আমি ব্রিস্টলে থাকি। সেখান থেকে যখন কলকাতায় আসি এই শহরটাকে দেখি সাদা চোখ দিয়ে। সত্যি ক্রিকেটের দুনিয়ায় অন্যতম অবাক করা শহর কলকাতা। শুধু ক্রিকেটের দুনিয়াই কেন, এমনিতেও পৃথিবীতে এমন শহরের জুড়ি মেলা ভার। এটা আমাকে বলতেই হবে যে, জনসংখ্যাকে পাশে রেখে তিলোত্তমার বাড়িঘর আর ফাঁকা জায়গাগুলো শহরটাকে আরও বিস্ময়কর করে তুলেছে। আমার শ্বশুরমশাই বাঙালি এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীও বটে। এই মুহূর্তে এখানেই থাকেন। আমার স্ত্রী তথা তাঁর কন্যাকে জানানোর আগে তিনি আমার এই লেখাটি পড়বেন।
বেশির ভাগ ইংরেজই লন্ডনের বাইরে ব্রিস্টলকেই তাঁদের সবচেয়ে পছন্দের শহর মনে করে। কারণ, ব্রিস্টলের খোলামেলা আবহাওয়া। যে শহরে পার্ক, ময়দান আছে, সেই শহরের ফুসফুস ভরে আছে মুক্ত হাওয়া। সেই শহরে আছে সবুজ ঘাসে ভরা খোলা মাঠ, আছে তারুণ্য, মজা, হাসি আর এক রাশ আশা। কলকাতাতেও যে সব ছোট ছোট ছেলে খোলা ময়দানে খেলাধূলা করে তারাই বড় হয়ে একদিন ইডেন গার্ডেনের দর্শক হবে।
ভারতের সাতটা মাঠের মধ্যে একমাত্র এই মাঠেই এত দর্শক বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর ফাইনাল দেখেছে। এমসিজি-ও তুলনা নয়। তাই বলাই যায় এই মাঠ বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক ক্রিকেটপ্রেমীকে খেলা দেখার সুযোগ দিয়েছে, আতিথ্য দিয়েছে।
ইডেন লর্ডসের মতো। লর্ডস যে রকম সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রিকেটপ্রেমীকে জায়গা দিতে পারে, তেমনই ভারতের মধ্যে একমাত্র ইডেনেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক বসে খেলা দেখতে পারে (লর্ডসে সংখ্যাটা এখনও তিরিশ হাজারের কম)। এখানেই হয়তো লর্ডসের থেকে ইডেন আলাদা। লর্ডস যখন দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে তখনও শান্ত, সমাহিত। একটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ম্যাচ চলার সময় আপনি যদি চোখ বন্ধ রাখেন তখন সামান্য গুঞ্জনের শব্দ ছাড়া কিছুই আপনার কানে আসবে না। তবে হ্যাঁ, মধ্যাহ্নভোজের সময় যত এগিয়ে আসে ততই সেই গুঞ্জনটা বাড়তে থাকে। এবং ওয়াইনের বোতল খোলা হতে থাকে। যখন একজন ব্যাটসম্যান একটা বাউন্ডারি হাঁকান আর হাততালি শুরু হয়, তখনই গুঞ্জনটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। যে দেশের ব্যাটসম্যানই তিনি হোন না কেন চিৎকার, চেঁচামেচি বা উচ্ছ্বলতা কখনওই শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না।
অন্য দিকে, ইডেনে সব থেকে বেশি চিৎকার চেঁচামেচি হয়। যদি সেটা একটা টেস্ট ম্যাচ হয়, তা হলে দর্শকেরা যে কোনও কিছু নিয়েই এমন উত্তেজনা দেখান, সেটা প্রায় একটা উৎসবের মেজাজে পৌঁছে যায়। পুরনো স্টেডিয়ামের নব্বই হাজার দর্শক, নতুন সংস্কার হওয়া স্টেডিয়ামে ছেষট্টি হাজার দর্শকের সঙ্গে মিলে এমন একটা আবেগের সৃষ্টি করে, যে দৃশ্য অমিল ক্রিকেট বিশ্বের অন্য যে কোনও জায়গায়।
তারা বিতর্ক ভালবাসে। সেটা প্রথম ছিল ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট’-কে ঘিরে। ’৮৪-৮৫ সালে ইংল্যান্ড এদেশ সফর করার সময় আওয়াজ উঠল, ‘নো কপিল, নো টেস্ট’। যখন গ্রেগ চ্যাপেল গাঙ্গুলিকে দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন তখন ইডেনে হুংকার উঠেছিল ‘নো সৌরভ, নো ওডিআই’। প্রচণ্ড বাজি ফাটছিল, টেরাসে জঞ্জাল পোড়ানো হচ্ছিল, স্টেডিয়ামের ভেতরে, বাইরে মানুষের জ্বলন্ত আবেগ তখন হিংসার চেহারা নিয়েছিল। পৃথিবীর আর কোথাও ইডেনের মতো এমন আবেগ দেখা যায় না।  কোনও কোনও সময় এই আবেগ ভারতের পক্ষে গিয়েছে। কোনও সময় তা বিপক্ষ দলকে সুবিধে করে দিয়েছে।
১৩৫ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘কামব্যাক’ ঘটে যখন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে ভি ভি এস লক্ষ্মণকে তিন নম্বর-য়ে তুলে আনা হয়। অস্ট্রেলিয়া তখন অপ্রতিরোধ্য জায়গায় থাকলেও লক্ষ্মণের ২৮১ তাদের ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
ইডেন। অস্ট্রেলিয়া। লক্ষ্মণ
’৯৯ সালে শোয়েব আখতার যখন প্রথম বলটা করতে ছুটে আসে শচীন তেন্ডুলকরকে, তখন শোয়েবও টগবগ করে ফুটছিল। যদিও আমি তখন মাঠে ছিলাম না। কিন্তু আশির দশকে বেশ কয়েকটা টেস্ট ম্যাচে আর ১৯৮৭-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হাজির থেকে আমি দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারি : ক্ষিপ্রতম গতিতে ছিটকে ওঠা বল করার জন্য শোয়েবের দীর্ঘ দৌড়, যা কিনা তখনকার ক্রিকেটে দীর্ঘতম, ওর মাথার পিছনে চুলগুলো উড়ছে, ক্রিজের ওপরে লাফিয়ে উঠছে শোয়েব। প্রথম বলেই উপড়ে দিয়েছিল তেন্ডুলকরের মিডল স্টাম্প। এতক্ষণ শোরগোল করতে থাকা দর্শকের মধ্যে তখন নেমে এল স্তব্ধতা। মনে হয় ইডেনের সমকক্ষ নিস্তব্ধতাও আর কোনও ক্রিকেট মাঠই হতে পারে না। লর্ডস নয়, এমসিজি নয়।
ইডেন গার্ডেনস একটা স্টেজ অপেরার স্পিরিটের ধারেকাছে আসে। যে স্টেজ অপেরার স্পিরিট ইংল্যান্ডের মতো নয় (যা ভীষণ শান্ত আর গম্ভীর), বরং ইতালির ভেরোনার পুরোনো রোমান থিয়েটারের মতো। একটা গ্রীষ্মের রাতে, যেখানে বিখ্যাত গায়কদের মতোই সুরের জাদু তুলতে তৈরি থাকেন স্থানীয়েরা। অথবা অনেকটা রোমের কলোসিয়ামের কাছাকাছি। পুরোনো ইডেনের স্ট্যান্ডগুলো আমার অনেক বেশি কলোসিয়ামের মতো লাগে। আর জীবন-মৃত্যুর দিক থেকে দেখলে সেখানে উপস্থিত নব্বই হাজার রোমানের প্যাশন হয়তো এর থেকে আর বেশি হতে পারে না।
ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে যখন ইংল্যান্ড মাত্র ৭ রানের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায়, সেই সময়ে আমার একটা ছোট স্মৃতি ভেসে আসছে। মনে পড়ছে স্কোরার রহমানের কথা। আমি যখন ইংল্যান্ডের ১৯৮১-৮২ সালের ভারত সফর নিয়ে বই লিখি, ‘ক্রিকেটওয়ালা’। তখন মুম্বইতে প্রথম টেস্টের পরে আর বিশেষ কিছুই লেখার ছিল না। কারণ, পরের পাঁচটা টেস্ট ছিল খুব একঘেয়ে ড্র। পিচ এমন ছিল, জেতা-হারা সম্ভব ছিল না। কিন্তু রহমান তাতেও পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা উদ্দীপনার মাত্রা যোগ করেছিল।
তখন এখন

• দেখা যেত মহিলাদের উল বোনার দৃশ্য।
• গঙ্গার ধার থেকে সকালে অনবরত হাওয়া আসত।
• শেষ দিন মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি ছিল ইংল্যান্ডের জিততে। অথচ খেলা দেখতে এসেছিলেন নব্বই হাজার দর্শক।

• উল বোনা দেখাই যায় না।
• উঁচু কংক্রিটের গ্যালারি গঙ্গার হাওয়া আটকে দিয়েছে।
• সচিন, রাহুল, লক্ষ্মণ, সহবাগ একসঙ্গে খেলেও টেস্টের প্রথম দিন পনেরো হাজারের বেশি দর্শক হয়নি।

মনে হত, রহমান যেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। চিৎকার করে ছেলেদের অ্যাসেম্বলিতে নিয়ে যাচ্ছে। একটা ইনিংস বা সেশনের শেষে ও প্রেস বক্সে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলত, ‘বলিং’! বলিং’! একটা হাতে পেন। আর এক হাতে থাকত খাতা। জুনিয়র স্কুল ছাত্রের মতো আমরা সবাই চুপ করে ওর বিশ্লেষণ শুনতাম। কিন্তু রহমানের আর প্রধান শিক্ষকের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। আর সেটা বোঝা যেত যখন রহমান চুপ করে কোনও বিষয়ের মজা নিত।
আমাদের প্রার্থনা, আজ থেকে শুরু হওয়া টেস্টটা এখনও পর্যন্ত ইডেনে হওয়া সবথেকে স্মরণীয় টেস্ট ম্যাচ হোক আর এটা যেন কোনও ভাবেই ১৯৮৪-৮৫ সালের ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের মতো ধীর গতির আর নীরস না হয়। ফিল এডমন্ডস গালিতে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
অন্তত, একটা টেস্ট ম্যাচ হবে। সেখানে এমন প্রতিবাদীরাও থাকতে পারতেন, যাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ড থাকত এই বলে, ‘নো মুখার্জি নো টেস্ট’। সেই বিতর্কটা এড়ানো গিয়েছে। কিন্তু ইডেন গার্ডেনের এমনই প্যাশন যে, এই সপ্তাহে নিশ্চয়ই আবার একটা বিতর্ক উঠে আসবে।

লেখক ‘সানডে টেলিগ্রাফ’-এর
ক্রিকেট লিখিয়ে, প্রাক্তন উইজডেন সম্পাদকৈ



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.