জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ভিড় হয়েছিল কমপক্ষে একলাখ জনতার। আর জেলা পুলিশ বলছে, সভায় প্রায় ৭০ হাজার লোক হয়েছিল।
তর্ক-বিতর্ক যাই থাক না কেন, পুরুলিয়া শহর থেকে ১৪ কিমি দূরের হুটমুড়া ফুটবল ময়দানে সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর সভা আক্ষরিক অর্থেই ছিল ভিড়ে ঠাসা। এবং সেই ভিড়ের একটা বড় অংশই স্বতঃস্ফূর্ত। দলীয় নেতা, কর্মী-সমর্থক তো ছিলেনই, সাধারণ মানুষও দলে দলে দেখতে এসেছিলেন তৃণমূল নেত্রীকে। মাঠ ছাপিয়ে সেই ভিড় চলে গিয়েছিল রাস্তায়। আর সেই জনসভা দেখে দৃশ্যতই উৎফুল্ল মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “এ তো দেখছি ব্রিগেডের (কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড) সভাকেও হারিয়ে দেবে!” যা শুনে সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য কমিটির সদস্য মণীন্দ্র গোপের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী হুটমুড়া ময়দানের ভিড়ের সঙ্গে ব্রিগেডের সভার তুলনা করেছেন। এটা খুবই হাস্যস্পদ ব্যাপার।”
বস্তুত, এ দিনের সভা থেকে কার্যত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার মমতা শুরু করে দিলেন বলেই রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন। যেন ‘কল্পতরু’ হয়ে জেলার জন্য ঘোষণা করেছেন একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প। দার্জিলিং পাহাড়ের আদলে পুরুলিয়ায় ‘হোম ট্যুরিজম’ গড়ে তোলা থেকে শুরু করে পুরুলিয়ার ধুঁকতে থাকা হোমিওপ্যাথি কলেজকে রাজ্যের অধিগ্রহণের চেষ্টা করা, জেলায় আইন কলেজ নির্মাণ থেকে রঘুনাথপুরে ব্যাপক শিল্পায়নমুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ঠাঁই পেয়েছে সব প্রসঙ্গই। |
তবে, মুখ্যমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে সভার ভিড়ের বহর। এ দিন বেলা বাড়তেই গাড়ি ও বাসে করে দলে দলে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা ভিড় করেছিলেন সভায়। সব মিলিয়ে কয়েকশো বাস-গাড়ি এসেছিল। বাস কম থাকায় নিত্যযাত্রীদের কিছুটা ভুগতে হয়েছে। সভা শেষে জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সিপিএমকে সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনও মতেই আর ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। এই ভিড়ই তারই প্রমাণ।” আর জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যর মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, “আমরা বার্তা দিয়েছিলাম মুখ্যমন্ত্রী জেলায় এসেছেন উন্নয়নের কাজ করতে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তাঁর মুখ থেকে উন্নয়নের কথা শুনতে সভায় এসেছিলেন।”
সকালে পুরুলিয়া শহরের সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক বৈঠক সেরে অন্যান্য মন্ত্রী, রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের নিয়েই পুরুলিয়া ২ ব্লকের হুটমুড়া ময়দানের সরকারি সভায় যান মুখ্যমন্ত্রী। সার্কিট হাউস থেকে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জাতীয় সড়ক ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় যখন ছুটছিল সভাস্থলের দিকে, তখন রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার আশায়। সার্কিট হাউস থেকে শ্মশানকালি সেতু পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো ভিড় দেখে মুখ্যমন্ত্রীও দু-দু’বার গাড়ি থেকে নেমে মিশে যান জনতার সঙ্গে। স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে আদরও করেন। ভিড়ের চাপ সামলাতে ব্যস্ত পুলিশকর্মীদের তখন নাজেহাল দশা। |
দুপুর প্রায় দুটো নাগাদ সভার কাজ শুরু হয়। প্রাক-মধ্যমিক সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান থেকে শুরু করে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির জন্য প্রকল্প ঋণ প্রদান, চাষিদের হস্তচালিত গাড়ি ও ক্রেট বিতরণ, মাওবাদী অধ্যুষিত ব্লকের ছাত্রীদের সাইকেল-সহ মোট ২৪টি প্রকল্পের অর্থ ও সামগ্রী বিলি করেন মুখ্যমন্ত্রী। সভাস্থল থেকেই শিল্যানাস করেছেন রঘুনাথপুরের ‘মাল্টি স্পেশ্যালাটি’ হাসপাতালের। বলেছেন, “জেলার মানুষদের চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হবে না।” জল প্রকল্প, ক্রীড়াবিদদের জন্য নতুন আবাসন ভবন নির্মাণ, আইটিআই-সহ দশটি প্রকল্পের শিলান্যাস এ দিন করে মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি উদ্বোধন করেছেন কাশীপুর ও নিতুড়িয়া ব্লকের তিনটি জলপ্রকল্প এবং কোটশিলায় কেন্দ্রীয় অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রী নিবাসের।
তবে বিতর্ক যে একেবারে ছিল না, তা নয়। সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কয়েক মাসের মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট। ৫০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। মা-বোনেদের পঞ্চায়েত হবে। গুন্ডা, হার্মাদ বা করে খাওয়ার পঞ্চায়েত নয়। কাজের পঞ্চায়েত, মানুষের পঞ্চায়েত হবে।” সরকারি জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী কী করে ‘হার্মাদ’ কথাটি বললেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকের বক্তব্য, “উনি শোভনতার ধার কোনও দিনই ধারেন না। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই জেলার মানুষকে অনেক কথা শুনিয়ে গিয়েছেন। আগের বারও বলেছিলেন অনেক কথা। তার কতটা বাস্তব আর কতটা ধাপ্পা, তা পুরুলিয়ার মানুষ ঠিকই বুঝতে পারবেন।”
|