ফের দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটল উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ-চাকদহ সড়কে। ফের প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ তুলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাল জনতা। উঠল ওই সড়কে মালবাহী ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণের পুরনো দাবি। রবিবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে গোপালনগর থানার ১০ মাইল সন্তোষপুর এলাকায়। বউভাত সেরে ফেরার পথে কনেযাত্রীদের গাড়ির সঙ্গে একটি ট্রাকের সংঘর্ষে মারা গেলেন ৫ জন। জখম হয়েছেন গাড়ির চালক-সহ ৬ জন। মৃতদের মধ্যে চারজন একই পরিবারের। হতাহতেরা সকলেই নদিয়ার শান্তিপুরের ফুলিয়ার বাসিন্দা বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহতদের একজনকে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল ও অন্যদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃতদের নাম গোরাচাঁদ সমাদ্দার (৪২), লক্ষ্মী সমাদ্দার (৩০), সায়ন্তন সমাদ্দার (১২), অনুষ্কা সমাদ্দার (৬) ও চিরঞ্জিৎ বসাক (২০)। |
গোরাচাঁদবাবু ঘোলা থানার কনস্টেবল ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। চিরঞ্জিৎবাবুর কাপড়ের ব্যবসা রয়েছে। দুর্ঘটনার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১ নম্বর নতুন ফুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা রিনা বিশ্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয় বনগাঁর পূর্বপাড়ার বাসিন্দা কপিল মজুমদারের। রবিবার রাতে পূর্বপাড়ায় একটি বাস ও গাড়িতে কনেযাত্রীরা বউভাতে এসেছিলেন। ফেরার সময় সন্তোষপুরে তাঁদের গাড়ির সঙ্গে উল্টোদিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। দুমড়ে-মুচড়ে যায় গাড়িটি। প্রচণ্ড শব্দে ছুটে আসেন স্থানীয় লোকজন। তার আগেই অবশ্য ট্রাক নিয়ে পালায় চালক। উদ্ধার করা হয় আরোহীদের। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দু’জনের। বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় মারা যান আরও দু’জন। কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান লক্ষ্মীদেবী।
সোমবার হাসপাতালে শুয়ে কনেযাত্রীদের গাড়ির এক আরোহী বিশ্বজিৎ বসাক বলেন, “গাড়ির পিছনের দিকে বসেছিলাম। হঠাৎ চোখে আলোর ঝলকানি ও তারপর প্রচণ্ড আওয়াজ। ব্যস, আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরতে দেখি হাসপাতালে শুয়ে।” দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটির পিছনেই ছিল বাসটি। বাসের যাত্রী ও বেলঘরিয়া-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য অরবিন্দ প্রামাণিকের দাবি, ট্রাকটিতে গরু বোঝাই ছিল। বেপরোয়া ভাবে এসে সেটি সরাসরি গাড়িতে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছিই বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, “ঘুমোচ্ছিলাম। মাঝরাতে প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি এই অবস্থা। আর একটা গরুবোঝাই ট্রাক চলে যাচ্ছে।” |
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাস্তার দু’পাশেই বেআইনি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সীমান্তের পণ্যবোঝোই ট্রাক। ফলে মাঝখানে সরু রাস্তায় দু’দিকের গাড়ি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা এবং তাতে মৃত্যু ঘটলেও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। এ নিয়ে বহুবার অবরোধ, বিক্ষোভ হয়েছে। স্থানীয় বিধায়কও সমস্যা সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু বেআইনি পার্কিং নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁদের আরও অভিযোগ, পুলিশের একাংশ ট্রাকগুলি থেকে তোলা আদায় করার জন্যই তারা কোনও আইন মানে না। পাশাপাশি রাতে সীমান্তে গরু পাচারের জন্য গরুবোঝাই ট্রাকের বেপরোয়া চলাচলও দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন। বেআইনি পার্কিং এবং ওই রাস্তায় গরুবোঝাই ট্রাকের যাতায়াত অস্বীকার না করলেও রবিবার রাতের দুর্ঘটনায় ঘাতক ট্রাকে গরু থাকার কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশের বক্তব্য, কনেযাত্রীদের গাড়িটি রাস্তার বাঁদিক ছেড়ে ডানদিকে চলে আসায় ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। তা ছাড়া দু’টি গাড়িই বেপরোয়াভাবে চালানো হচ্ছিল। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারানোয় এই দুর্ঘটনা। এ দিকে বাসের যে যাত্রী ট্রাকে গরু ছিল বলে দাবি করেছেন, পুলিশের বক্তব্য তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি তা দেখেননি।
জেলার পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “ঘাতক ট্রাকটির খোঁজ চলছে। তাতে কি ছিল তা দেখা হচ্ছে। ওই রাস্তায় মালবোঝোই ট্রাকের বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস বলেন, “গরুপাচার ও বেআইনি পাকির্ং বন্ধ করতে আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) ও পুলিশ সুপারকে বলা হয়েছে।”
দুর্ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ অবিলম্বে ওই রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ, বেআইনি পার্কিং বন্ধ ও গরুবোঝাই ট্রাকের যাতায়াত বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ গিয়ে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভ থামে। ফের সোমবার সকালে বিক্ষোভ শুরু করেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং ফুলিয়া থেকে আসা লোকজন। বেলা ১২টা পর্যন্ত অবরোধ চলে। আটকে পড়ে বহু যানবাহন। বনঁগা-চাকদহ সড়কের দু’পাশে থাকা গার্ডরেল সরানো ও গরু পাচার বন্ধের দাবি তোলেন বিক্ষোভকারীরা। দাবি মেনে পুলিশ গার্ডরেলগুলি সরিয়ে নিলে অবরোধ ওঠে।
|