ছাদনাতলাটা এখনও আছে। কলাগাছগুলো শুকিয়ে গিয়ে পরস্পরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। উঠোন জুড়ে বাঁশের খুঁটির গর্ত। এখানে ওখানে বিয়ে বাড়ির ভোজের বাসি খাবারের গন্ধ।
ফুলিয়ার এই বাড়িতেই বড় মেয়ের রিনার বিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস। সেই আনন্দ মুছে গিয়েছে বরিবার রাতে। বউভাতের অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথবাবুর মামাতো দিদির ছেলে গোরাচাঁদ সমাদ্দার আর তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। হ্যাঁ এক রাতেই গোটা পরিবারটা মুছে গিয়েছে।
ঘোলা থানার কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন গোরাচাঁদ। তাঁর স্ত্রী লক্ষী সমাদ্দার, তাঁদের ছেলে ফুলিয়া শিক্ষা নিকেতনের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সায়ন্তন সমাদ্দার ও মেয়ে আনন্দ নিকেতন শিশু বিহার স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী অনুষ্কা দপর্ঘটনায় মারা গিয়েছে সকলেই। মারা গিয়েছেন গোরাচাঁদবাবুর শ্যালক চিরঞ্জীব বসাকও। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন গোরাচাঁদবাবুর বৌদি ও ভাইপো এবং লক্ষীদেবীর দাদা,বৌদি এবং গাড়ির চালক। গাড়ির ভিতরে ছিলেন লক্ষীদেবীর আর এক ভাই বিশ্বজিৎ বসাক। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার মধ্যে আশ্চর্য্যজনক ভাবে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। কপালের ডান দিকে সামান্য আঘাত ছাড়া তার তেমন কিছুই লাগেনি।
কিন্তু এতগুলো মৃত ও আহত প্রিয় মানুষের ভিড়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। গাড়ির পিছনে বসেছিলেন বিশ্বজিৎবাবু। তার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাগ্নে সায়ন্তন। বাড়ির বারান্দায় সেই প্রসঙ্গ তুলেই ঘনঘন ডুকরে উঠছেন তিনি।
দুজনের বাড়িই একেবারে পাশাপাশি। গোরাচাঁদবাবু ও তাঁর স্ত্রী হাতে করেই তার বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন। কন্যাযাত্রী গিয়েছিলেন একই রকম উৎসাহ নিয়ে। শ্যালকের নতুন কেনা গাড়ি নিয়ে নিজেদের মত করেই কন্যাযাত্রী গিয়েছিলেন গোরাচাঁদবাবু। বাসে করে গিয়েছিলেন বাকি কন্যাযাত্রী। মা অসুস্থ থাকায় বাড়ি ফেরার তাড়া দিচ্ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন,“আমার দিদির শরীরটা খারাপ। জামাইবাবুরও বয়স হয়েছে। দিদিকে ডাক্তার দেখাতে হবে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া দিচ্ছিল গোরাচাঁদ। গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে বলল সাবধানে আসবে। আমরা সাবধানে এলাম। কিন্তু ওরা হারিয়ে গেল চিরদিনের মত।”
দুর্ঘটনায় গোটা পরিবারের মৃত্যুর ঘটনায় গোটা মাঠপাড়া জুড়েই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সকাল থেকেই বানির ুঠানে উপচে পড়ছে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের ভিড়। একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছিলেন ৬৭ বছরের বৃদ্ধা গোরাচাঁদবাবুর মা উষারাণীদেবী। বিষয়টি কানে আসার পর থেকে নিজের বিছানায় পাথরের মত বসে আছেন গোরাচাঁদবাবুর বাবা গোবিন্দ সমাদ্দার। গোবিন্দবাবুর ভাই সুনীল সমাদ্দার বলেন,“নাতি আর নাতনি ছিল দাদর জীবন। এক মুহুর্তও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারত না। সারাদিন যেন পরীর মত উড়ে বেড়াত মেয়েটা। যেন সবকিছু একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেল।” অন্যদিকে চিরঞ্জীববাবুর মৃত্যুতে গভীর শোকাহত ফুলিয়ার তাঁত শিল্পীরা। জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিয়ালের একটি জনপ্রিয় চরিত্রের জন্যে বিশেষ ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হয়েছিল তার হাত দিয়েই। |