অবলুপ্তির হাত থেকে ঐতিহাসিক নশিপুর রাজবাড়ি রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন লালবাগের ৫ যুবক। সঙ্গে রয়েছেন রাজা দেবী সিংহের বর্তমান বংশধর রাজা সৌরেন্দ্রমোহন সিংহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিশিষ্ট কারু ও চিত্রশিল্পী পঞ্চনন কর্মকার। কেবল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা নয়, লালবাগের পর্যটন শিল্প সামনের দিকে এক কদম এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁরা। কয়েক মাসের চেষ্টায় ভাঙাচোরা ওই রাজপ্রাসাদের ভোল পাল্টেছে। সংস্কারের ফলে জরার্জীণ দশা ঝেড়ে ফেলে প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন নশিপুর রাজবাড়িটি সাবেক আমলের আদল আপাতত কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে।
লালবাগের ওই রাজপরিবারের প্রাচীন সামগ্রী প্রদর্শন করা ছাড়াও সেখানে দু’টি বিশাল ঘর জুড়ে শিল্পী পঞ্চাননবাবুর সৃষ্ট শিল্প প্রদর্শনের জন্য স্থায়ী আর্ট গ্যালারিও খোলা হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক নাটমন্দির-সহ বিঘা আটেক এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হনুমান মন্দির, কালী মন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ। ডাইনিং রুমের দেওয়ালের পাশে মেঝের উপর মেহগিনি কাঠের কারুকার্যময় ৮ ফুট উচ্চতার ‘গ্রান্ড ফাদার ক্লক’। ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ওই বাড়িটি হাজার দুয়ারির আদলে নির্মাণ লোকমুখে সেটি অবশ্য দেবী সিংহের রাজবাড়ি হিসাবেই বেশি খ্যাত।
ইংরেজ ঐতিহাসিক বর্ক ও সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে ১১৫ বছর আগে লেখা ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনি’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় নৃশংসতায় ও প্রজা পীড়নে দেবী সিংহকে সাইলকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনিই ফের ওই একই লেখায় নিঃসন্তান দেবী সিংহের উত্তরাধিকারীদের ‘দেশহিতৈষী’ ও ‘উচ্চ হৃদয়’-এর অধিকারী বলে বর্ণনা করেছেন। বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রৌঢ় সদস্য সৌরেন্দ্রমোহন সিংহ বলেন, “মন্দির, নাটমন্দির, রাজবাড়ি মিলে মোট আয়তন প্রায় ২০ বিঘা। সেখানে ৭০টি ঘর সম্বলিত অন্দরমহল ছিল। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক অনটনে সংস্কার করা যায়নি। তার ফলে ওই বিশাল অন্দরমহল আজ অবলুপ্ত।” |
তিনি বলেন, “ওই পরিণিতি থেকে অবশিষ্ট রাজপ্রসাদ ও মন্দির বাঁচাতে নশিপুরের ৫ যুবককে ওই সম্পত্তির শতকরা ৮০ ভাগ ৬০ বছর লিজে দেওয়া হয়েছে। বাকি ২০ ভাগ আমাদেরই রয়েছে। অর্থাৎ ওই ৫ জন ও আমরা মিলে যৌথ ভাবে রাজবাড়ি সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণ করার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। সেই সঙ্গে পর্যটকদের উদ্দেশ্যে রাজবাড়ি ও মন্দির খুলে দেওয়া হয়। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে স্থায়ী আর্ট গ্যালারি করার জন্য বিনাভাড়ায় পঞ্চাননবাবুকে দু’টি ঘর দেওয়া হয়েছে।”
সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ‘নবাব বাহাদুর ইন্সটিটিউশানে’র অবসরপ্রাপ্ত ‘ড্রইং’ শিক্ষক পঞ্চাননবাবু বলেন, “চক, মাটি, অ্যলুমিনিয়ামে তার ও টুকরো, কাগজের মণ্ডের তৈরি বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী ছাড়া গ্যালিরিতে রয়েছে প্যাস্টেল, অয়েল পেন্টিং ও স্কেচের প্রায় ৫০টি চিত্রকর্ম। আর্ট গ্যালারি করায় প্রচুর দর্শক সেগুলি দেখছে।”
নশিপুরের ৫ উদ্যোগপতি যুবকের মধ্যে রয়েছেন পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রদীপ ঘোষ ও তপন ঘোষ। তাঁরা দু’ জনেই বলেন, “চার-পাঁচটি সিনেমার শু্যটিং হয়েছে ওই রাজবাড়িতে। সেই রাজবাড়ির ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রস্তাব দেন রাজামশাই সৌরেন্দ্রমোহনবাবু নিজেই। তখন আমাদেরও মনে হল, পর্যটনের কাজে লাগিয়ে উর্পাজনের পাশাপাশি আমাদের এলাকার ঐতিহ্য রক্ষা করার মতো দায়িত্বও পালন করা হবে। তাই রাজি হলাম। আপাতত প্রকল্প ব্যয় এক কোটি টাকা। কাজ সবে শুরু হয়েছে। গত ৮ নভেম্বর থেকে রাজবাড়ি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। শুরুতেই দৈনিক পর্যটক সংখ্যা গড়ে শ’ চারেক। ভরা মরশুমে সংখ্যাটি বাড়বে।” নশিপুর রাজবাড়ির অবস্থান পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুরপ্রধান শম্ভুনাথ ঘোষ বলেন, “বেসরকারি উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের পর্যটন শিল্পে সুবাতাস বইবে।”
আশাবাদী দু’টি বেসরকারি সংস্থা —‘সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী সমিতি’ ও ‘পর্যটক সহায়তা কেন্দ্র’-এর সম্পাদক স্বপনকুমার ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, “ওই রাজবাড়ির মধ্যে রয়েছে বিঘা আটেক এলাকা জুড়ে হনুমানজির মন্দির, কালীমন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির ও নাটমন্দির। নিমকাঠের তৈরি দু’শো বছরের প্রাচীন বিশালাকৃতির দেবদেবীর কয়েক ডজন মূর্তি, ৬ ফুট উচ্চতার কাঠের তৈরি রামগড়ুরের বিস্তৃত দু’টি ডানার উপর অধিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণের যুগলমূর্তি। পর্যটকদের জন্য এ জাতীয় প্রায় অর্ধশত বিগ্রহ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার সুফল অবশ্যই পড়বে পর্যটন শিল্পে।” |