আগেই বলেছিলেন, জমির দাম পেলে তাঁরা বেঁচে যান। আর এ বার বর্তমান বাজার দরে সেই দাম দেওয়ার দাবি তুললেন সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরা। ফলে যে সিঙ্গুরে ভর করে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা, সেই সিঙ্গুরে তাদের পায়ের তলার মাটি শুধু আলগাই হচ্ছে না, ঝঞ্ঝাটও বাড়ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দেড় বছর পরেও জমি ফেরত না-পেয়ে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। টাটাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের হারের পরে মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ানোয় জমি ফেরত যে বিশ বাঁও জলে, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন তাঁরা। ক’দিন আগে কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নার সামনে তাঁরা সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। এমনকী গত শুক্রবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুর গেলেও তাঁর সফর ঘিরে বলতে গেলে কোনও আগ্রহই ছিল না সিঙ্গুরবাসীর।
এই উল্টো স্রোত সামাল দিতে রবিবার সিঙ্গুরে বিচারব্যবস্থাকে দুষে জানুয়ারির মধ্যে জমি ফেরানোর আশা দেখিয়েছেন বেচারাম। বলেছেন, মামলায় হার হলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু প্রায় সুনসান সভায় তাঁর সেই ঘোষণা যে অনিচ্ছুক চাষিদের উপরে প্রায় কোনও প্রভাবই ফেলেনি, সেটা সোমবার সিঙ্গুরে ঘুরেই বোঝা গেল। বাজেমিলিয়ার বাণেশ্বর মাঝি, মহাদেব কোলে বা মুরারি পাঁজার মতো অনিচ্ছুকরা বলছেন, আর আন্দোলন নয়। জমির দাম পাওয়ার জন্য তাঁরা এখন ব্লক অফিসে দরখাস্ত করার কথা ভাবছেন। |
ছ’বছর আগে জমির যে দাম দেওয়া হয়েছিল, এখন তা নিতে রাজি নন অনিচ্ছুকরা। তাঁদের দাবি, দাম দিতে হবে বর্তমান বাজার দরে। তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইচ্ছুক জমিদাতাদের অনেকে বলছেন, কারখানা না-হওয়ায় তাঁরা কাজ পাননি। অতএব তাঁদেরও ক্ষতিপূরণ চাই।
বস্তুত, তৃণমূল এখনও সিঙ্গুর-আবেগ বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেও তাতে আর গা ভাসাতে রাজি নন অনিচ্ছুক চাষিরা। সংসার চালানোর জন্য তাঁরা এখন টাকা চান। বাণেশ্বর মাঝির দেড় বিঘা জমি চলে গিয়েছে টাটাদের প্রকল্প এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন করে এখন তিনি বলছেন, “তখন স্বেচ্ছায় জমি দিলে কারখানা হয়ে যেত। কোনও গোলমাল হত না। জমির দাম নিয়ে ব্যাঙ্কে রাখলে এত দিনে দ্বিগুণ হত। ভুল করেছি। মুখ্যমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রাখতে পারেননি। ব্লক অফিসে টাকার জন্য আবেদন করব। এখনকার বাজার-দর অনুযায়ী টাকা চাই।”
জমি-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া মহাদেব কোলের নামে এখনও ৬টি মামলা রয়েছে আদালতে। তাঁর দেড় বিঘা জমি চলে গিয়েছে টাটাদের প্রকল্পে। তাঁর কথায়, “জমি কি আর ফেরত পাব! অনেক আন্দোলন হয়েছে। এ বার ব্লক অফিসে গিয়ে দরখাস্ত করব। তবে ছয় বছর আগে যে দাম ছিল, তা কিন্তু নেব না। জমির দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তাই তিন গুণ দাম চাই।” আর এক অনিচ্ছুক গোপাল ঘোষ জানান, তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সকলে যা করবে, তিনিও সেই পথে হাঁটবেন। সানাপাড়ার অনিচ্ছুক মুরারি পাঁজার বক্তব্য, “টাকা নেওয়ার জন্য হাঁ করে আছি।” মুরারিবাবুর প্রতিবেশী সুশান্ত বাগেরও একই সুর, “সমস্যা সমাধান কবে হবে জানি না। চেক নিয়ে নেব। এখনকার দামই চাইব। তার পরে দেখি কী হয়!”
অনিচ্ছুকদের এই সব দাবিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি নন সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনের অন্যতম মুখ বেচারাম মান্না। তাঁর দাবি, “চাষিরা আমাদের পাশেই আছেন। ৬ বছর ধরে জমি ফেরত না-পাওয়ায় একটা হতাশা কাজ করছে। এটা সঙ্গত। ওঁরা চাইছেন, সরকার যাতে সাহায্যের পরিমাণ আরও বাড়ায়। আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এ ব্যাপারে আর্জি জানাব।” চন্দননগরের মহকুমাশাসক বিশ্বনাথ জানিয়েছেন, অনিচ্ছুকরা ব্লক অফিসে গিয়ে চেকের জন্য দরখাস্ত করতেই পারেন। বিশেষজ্ঞ কমিটি এ ব্যাপারে বিবেচনা করে দরখাস্ত নেবেন। তাঁরাই ঠিক করবেন কী ভাবে চেক দেবেন।
যাঁরা ইতিমধ্যেই জমি দিয়ে চেক পেয়ে গিয়েছেন, তাঁরাও অনিচ্ছুকদের সুরে সুর মিলিয়েছেন। বাজেমিলিয়ার মহাদেব সাঁতরার কথায়, “জমির দাম পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু কারখানা হলে ৩৬৫ দিনই কিছু না কিছু কাজ পেতাম। আমিও এখন ক্ষতিপূরণ চাই।”
বাজেমিলিয়ার রাজকুমার মালিক এবং তাঁর ভাই নবকুমার টাটাদের কারখানার জন্য স্বেচ্ছায় জমি দিয়ে কাজের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কিন্তু কারখানা না-হওয়ায় সেই প্রশিক্ষণ কোনও কাজে আসেনি। রাজকুমারের কথায়, “১৫ মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমরা। কী হল? এখানে সমস্যা মিটবে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমরাও তো এত দিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। জমিটার তো কোনও গতি হল না।”
সিঙ্গুর জুড়ে এখন একটাই দাবি ক্ষতিপূরণের টাকা। |