মাল্লেজুলা কোটেশ্বর রাওয়ের মৃত্যুর পরে কেটে গেল এক বছর। বিভিন্ন মহলে মূল্যায়ন শুরু হয়েছে, এই এক বছরে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের কতটা পরিবর্তন হল? কিন্তু কিছু ভিন্ন প্রশ্নও আছে। যেমন, কিষেণজির মৃত্যু-পরবর্তী এই যে কাল, এর মধ্যে মাওবাদী রাজনীতির অবস্থান কোথায়? দলের রণনীতিতে কি কিছু বদল ঘটালেন গণপতি ও দলীয় নেতৃত্ব?
মাওবাদী আন্দোলন কি তাঁর সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে উড়াল দিতে পেরেছে আরও বড় আকাশে? বরং, অহেতুক শক্তিক্ষয় হয়েছে তাঁদের। লালগড়ে যৌথ বাহিনীর ‘অত্যাচার’ প্রতিরোধে ‘পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি’ যখন তৈরি হয়, তখন ভূমিপুত্রদের সেই আন্দোলনে মাওবাদীরা প্রত্যক্ষ ভাবে সামিল হয়েছিলেন। কেন? আত্মগোপন করে থাকা বিপ্লবী দলের আদর্শ মেনে কেন পিছনে থেকে তাঁদের রাজনৈতিক লাইনকে আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন না? কেন ২০০৯-এর জুনে অনুজ পাণ্ডের বাড়ি ভাঙার পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় মাওবাদী নেতা বিকাশকে? ‘স্বতস্ফূর্ত জনরোষ’-এর কথা বলতে জনতার প্রতিনিধিকে কেন সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হল না? |
জনসাধারণের কমিটি গঠনের পর থেকে একের পর এক খুনখারাপি হয়েছে এই রাজ্যের জঙ্গলমহলে। ২০০৯-এ জঙ্গলমহলে মোট ১৫৮ জন মারা যান ১৩৪ জন সাধারণ মানুষ, মাওবাদী ৯ জন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানের সংখ্যা ১৫। ২০১০-এ মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৫। তাঁদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ৩২৮ জন। মাওবাদী ৬১ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ৩৬ জন। ২০১১-য় এই সংখ্যা কমে আসে।
অভিযোগ উঠেছে, ‘শ্রেণিশত্রু’ খতমের নামে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নির্বিচার খুনখারাপি চলেছে। কিষেণজি, বিকাশ বা অন্যান্য মাওবাদী নেতা সে সব ঠেকাতে যথেষ্ট সক্রিয় হননি কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে মাওবাদীদের শান্তি আলোচনার প্রয়াস যখন চলছে, সে সময়েও আচমকা জঙ্গলমহলে হত্যাকাণ্ড ঘটে। মাওবাদী শীর্ষনেতা গণপতিও এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, লালগড় তাঁদের দুর্বলতম জায়গা। মাওবাদীদের শীর্ষস্তরের মূল্যায়নই হল, জঙ্গলমহলের অধিকাংশ খুনই অপ্রয়োজনীয়।
কিন্তু, এই নির্বিচার হত্যালীলা মাওবাদী আন্দোলনকে সামগ্রিক ভাবে কোথায় ঠেলে দিল? ভয়ে-আতঙ্কে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলেন জনসাধারণের কমিটি তথা মাওবাদীদের কাছ থেকে। কিষেণজির ধরা পড়ার পিছনেও এই হত্যার রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। জনসাধারণের কমিটির কিছু নেতার জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন তুললেন তাঁরা।
নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবশ্য ওড়িশাতেও সরব হয়েছেন মাওবাদী নেতা সব্যসাচী পন্ডা। তাঁর অভিযোগ, দল আদিবাসী, সংখ্যালঘু এবং জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলেছে। ওড়িশার কিছু মাওবাদী নেতার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তিনি। তার পর প্রেস বিবৃতি দিয়ে মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্ব সব্যসাচীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানান।
ঝাড়খণ্ড, বিহার বা ছত্তীসগঢ়েও কি নিশ্চিন্ত কাটাতে পারছেন মাওবাদীরা? নতুন ‘রিক্রুট’ কার্যত হচ্ছে না। অধিকাংশ তরুণ-তরুণী এই চরম অনিশ্চয়তার রাজনীতিতে সামিল হতে চাইছেন না। আজাদ, কিষেণজির মতো দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই মারা গিয়েছেন, অনেকে কারাগারে বন্দি। মাওবাদীদের দলীয় সংগঠন এই মুহূর্তে বেশ কিছুটা ছন্নছাড়া। তথাকথিত ‘রেড করিডর’-এর বাইরে কি এক ইঞ্চি জমি দখলে আনতে পেরেছেন তাঁরা?
ফলে, শান্তি আলোচনার তাগিদও কেন্দ্র বা কোনও রাজ্য সরকারেরই নেই। দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীর তো দর কষাকষির অবকাশ থাকে না! থাকলে ফিলিপিন্সের মাওয়িস্ট লিবারেশন আর্মি-র মতো সরকারের সঙ্গে নরওয়েতে শান্তি আলোচনায় তারা শর্ত দিত যে, রাজপথে তারা সশস্ত্র কুচকাওয়াজ করবে, কেউ তাদের ধরতে পারবে না। শান্তি আলোচনার শর্ত হিসেবে সেখানে আলোচনা চলছে, আসন্ন খ্রিস্টমাসের ছুটিতে মাওবাদী নেতারা তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এলেও তাঁদের গ্রেফতার করতে পারবে না সরকার!
মূল ধারার ‘সিস্টেম’-এর শরিক হয়ে গেলে কী হয় তা তো নেপালের মাওবাদী নেতৃত্ব এত দিনে ভালই বুঝে গিয়েছেন! না হলে প্রকাশ্য জনসভায় দলীয় কর্মীর হাতে চড়ই বা খাবেন কেন একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড? এই ‘সিস্টেম’ তো সব সময়েই চাইবে মাওবাদী নেতা-কর্মীরা আত্মসমর্পণ করুন। কারণ, বিরুদ্ধ স্বর ‘সিস্টেম’-এর অংশ হয়ে গেলে শাসক দলের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়!
এই পরিস্থিতিতে মাওবাদী নেতৃত্ব কি পার্টি লাইন নিয়ে নতুন করে ভাববেন? বন্দুকের ভাষা বদলাতে বাধ্য হবেন?
কিষেণজির মৃত্যুর ‘বর্ষপূর্তি’ উদযাপনের এই পর্বে এ সব প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে গণপতিদের! |