প্রবন্ধ ১...
জনকল্যাণ আর খোলা বাজার, দুটোই জরুরি
ছর চারেক হল, মন্দার ধাক্কায় ইউরোপের অর্থনীতি একেবারে শুয়ে পড়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো। ইউরোপীয় কমিশন হিসেব কষে বলেছে, ২০০৮-এর সংকটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নে বেকারত্বের গড় হার ছিল ৭.১ শতাংশ (১৫-৭৪ বছর বয়সি যত লোক বেকার, সেই সংখ্যাটি মোট চাকুরিরত মানুষের যত শতাংশ, তা-ই হল বেকারত্বের হার)। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে এই হার অনেক কম ছিল নরওয়েতে আড়াই, আইসল্যান্ডে তিন এবং ডেনমার্কে ৩.৪ শতাংশ। সুইডেন আর ফিনল্যান্ডে বেকারত্বের হার অপেক্ষাকৃত চড়া ছিল বটে যথাক্রমে ৬.২ ও ৬.৪ শতাংশ কিন্তু বাকি ইউরোপের তুলনায় তা ঢের ভাল। স্পেন (১১.৩%) বা গ্রিস (৭.৭%) তো বটেই, ফ্রান্স (৭.৮%) এবং জার্মানিতেও (৭.৫%) বেকারত্বের হার ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড়ের তুলনায় বেশি ছিল।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো কী ভাবে মন্দার ঝড় এড়িয়ে গেল? পরিচিত উত্তর এই দেশগুলিতে যে মজবুত সামাজিক এবং আর্থিক ভিত রয়েছে, তার দৌলতেই। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবেই গোটা দুনিয়ায় পরিচিত। এই দেশে সামাজিক সুরক্ষার মাত্রা অত্যন্ত উঁচু। লন্ডনের লেগাটুম ইনস্টিটিউট ২০১০ সালে একটি সমৃদ্ধি সূচক প্রকাশ করেছিল। সমীক্ষায় মোট ১১০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড আর সুইডেনে সামাজিক বিশ্বাসের পরিমাণ সর্বাধিক ছিল। এই দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক বন্ধনও অত্যন্ত দৃঢ়, এবং তার ফলেই এই দেশগুলিতে মোট বেকারত্ব ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর সরকারি সাহায্যের মুখাপেক্ষী, এমন মানুষদের কোন দেশ কত টাকা বেকারত্ব ভাতা দিয়েছে, তা দেখলেই ছবিটা স্পষ্ট হবে। ২০০৯ সালে এমন বেকার মানুষপিছু ডেনমার্ক খরচ করেছে ২০,৬৯৪ ইউরো, নরওয়ে ১৬,২৭৭ ইউরো, সুইডেন ৭,৬৯৬ ইউরো। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির গড় ৩,৬৮৭ ইউরো। ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্য যে দেশগুলি সচ্ছল, তাদের মধ্যে জার্মানিতে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ৩,৪১৭ ইউরো, ফ্রান্সে ৫,৫০০ ইউরো।
এই সমীক্ষা বলছে, আর্থিক সমৃদ্ধি এবং নাগরিক-সন্তুষ্টির মাপকাঠিতে নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড আর সুইডেন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলির তালিকাভুক্ত। যে ১১০টি দেশের মধ্যে এই সমীক্ষা হয়েছিল, তার মধ্যে এই চারটি দেশ যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। ভারত? তালিকায় ৯১ নম্বরে!
তবে, শুধু রাষ্ট্রের বড় মাপের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির কথা বললেই চলবে না। আরও কারণ রয়েছে।
সমৃদ্ধ। ইউরোপ যখন বিধ্বস্ত, তখন নরওয়ের রাজধানী
অসলোয় চলছে পুরনো বন্দরের পুনর্নির্মাণের কাজ। ছবি: এ এফ পি
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলির অর্থনীতির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ অতি সামান্য, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দাপটও নেই। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার আর্থিক সংকটের পর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি আর্থিক সংস্কারে আরও বেশি মনোযোগী হয়, আরও বেশি করে বাজারমুখী আর্থিক নীতি গ্রহণ করে। তারা মুক্ত বাণিজ্যের জন্য দেশের দরজা খুলে দেয়, অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণের রাশ বহুলাংশে আলগা করে, এমনকী কল্যাণমূলক খাতে ব্যয়েও লাগাম টানে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডেনমার্ক ও সুইডেন দেশে শ্রমের বাজার মুক্ত করে দেয় এবং তার পর থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি কম-বেশি উদার বাণিজ্যিক নীতিই বজায় রেখে চলেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউরোপে ডেনমার্কের শ্রমের বাজারই সবচেয়ে নমনীয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে দারিদ্রকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখা হয়, যাকে বলা হয় ‘মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি’। তিনটি পৃথক বর্গের হিসেব কষা হয় এক, কত জন মানুষের দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; দুই, কত জন মানুষ সম্পদের নিরিখে অত্যন্ত বঞ্চিত; এবং তিন, কর্মসংস্থানের মাত্রা অত্যন্ত কম, এমন পরিবারে কত জন মানুষ বাস করেন। এই তিনটি বর্গের জনসংখ্যার যোগফল হল দেশে দরিদ্রের সংখ্যা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম অনুসারে, কোনও এক জন মানুষ যদি দুটি বা তিনটি বর্গেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো অবস্থায় থাকেন, তবুও তাঁকে মাত্র এক বারই গোনা হবে। তিনটি বর্গের সংজ্ঞা দেখে নেওয়া যাক। দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কাদের? ‘রিস্ক অব পভার্টি থ্রেশহোল্ড’ বলে একটি আয়কে নির্দিষ্ট করা রয়েছে আয়ের ভিত্তিতে দেশের সব মানুষকে পর পর দাঁড় করিয়ে দিলে যিনি ঠিক মধ্যিখানে থাকবেন, তাঁর আয়ের ৬০ শতাংশকে ধরা হচ্ছে ‘রিস্ক অব পভার্টি থ্রেশহোল্ড’। সরকার থেকে যে টাকা পাওয়ার, তাকে ধরে যদি কোনও মানুষের আয় এই বিপদসীমার নীচে হয়, তবে ধরা হয়, তাঁর দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্পদের নিরিখে অত্যন্ত বঞ্চিত কারা? অর্থাভাবের দরুন করা যায় না, এমন কাজের একটি তালিকা আছে বাড়িভাড়া বা বিভিন্ন বিল না দিতে পারা; ঘর যথেষ্ট গরম না রাখতে পারা; হঠাৎ এসে পড়া খরচ করতে অপারগ হওয়া; অন্তত এক দিন অন্তর মাছ, মাংস বা অন্য কোনও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার না খেতে পারা; সপ্তাহান্তে এক বার কোথাও বেড়াতে যেতে না পারা; গাড়ি কিনতে না পারা; ওয়াশিং মেশিন কিনতে না পারা; রঙিন টেলিভিশন কিনতে না পারা; বাড়িতে ফোন না থাকা। যাঁরা অর্থাভাবে এই ন’টির মধ্যে অন্তত চারটিতে অপারগ, তাঁরা সম্পদের নিরিখে অত্যন্ত বঞ্চিত। পরিবারে কর্মসংস্থানের মাত্রা অত্যন্ত কম, এমন মানুষ কারা? শূন্য থেকে ৫৯ বছর বয়সি যে কেউ, যার বাড়িতে পূর্ণবয়স্ক মানুষরা (১৮ থেকে ৫৯-এর মধ্যে যাঁদের বয়স) গত এক বছরে যত ক্ষণ কাজ করেছেন, তা তাঁদের কাজ করার সর্বাধিক সীমার ২০ শতাংশেরও কম।
এই মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি-র সংজ্ঞা অনুযায়ী দেখলে বোঝা যাবে, সর্বজনীন উন্নয়নের ক্ষেত্রেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি যথেষ্ট ভাল করেছে। দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন ডেনমার্কে এমন মানুষ মোট জনসংখ্যার ১৩.৩%, ফিনল্যান্ডে ১৩.১%, সুইডেনে ১২.৯%, নরওয়েতে ১১.২% এবং আইসল্যান্ডে ৯.৮%। প্রতিটি দেশেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড়ের (১৬.৪%) তুলনায় ঢের কম। সম্পদের নিরিখে অত্যন্ত বঞ্চিত মানুষের সংখ্যার মাপকাঠিতে দেখলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি আরও এগিয়ে রয়েছে। মোট জনসংখ্যায় এই গোত্রের মানুষের সংখ্যা ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে এবং আইসল্যান্ডে যথাক্রমে ৬%, ৮.৪%, ৩.৯%, ৫.৩% এবং ৬.৫%। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় হল ১৭.৫%। উল্লেখযোগ্য হল, কর্মসংস্থানের মাত্রা অত্যন্ত কম, মোট জনসংখ্যায় এমন পরিবারে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ডেনমার্কে ১০.৩%, ফিনল্যান্ডে ৯.১% ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় ১০%-র চেয়ে বেশি, বা সামান্য কম। কেন? তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে বেকারত্ব ভাতার হার চড়া। বেকার বসে থাকলেও যখন মাসে মাসে বেশ ভাল টাকাই পাওয়া যায়, তখন আর কাজ করব কেন এমন মনোভাবের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর্থিক বৃদ্ধি এবং সামাজিক কল্যাণের দু’রকম মডেল সম্ভব এক, শিথিল আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এবং চড়া হারে কল্যাণখাতে ব্যয়; দুই, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কম কল্যাণ ব্যয়। ১৯৯০-এর গোড়ায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি যখন শ্লথ আর্থিক বৃদ্ধি এবং চড়া কর্মসংস্থানহীনতার জোড়া বিপদে পড়েছিল, তখন তারা প্রথম পথটিতে হাঁটতে আরম্ভ করে। তারা অর্থনীতিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দেয়। কল্যাণব্যয় খানিক কমায় বটে, কিন্তু সমাজের দুঃস্থতম অংশটিকে তারা ভুলে যায়নি, ফেলে দেয়নি।

স্ক্যান্ডিনেভিয়া
• স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উপদ্বীপের পাঁচটি দেশ ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড আর আইসল্যান্ড এবং তাদের সংলগ্ন অঞ্চলের গ্রিনল্যান্ড, ফারো আইল্যান্ড এবং অ্যালান্ড অব নর্দার্ন ইউরোপকে এক সঙ্গে বলা হয় স্ক্যান্ডিনেভীয় (নর্ডিক) দেশপুঞ্জ।
• স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলির মোট আয়তন প্রায় ৩৫ লক্ষ বর্গ কিমি। জনসংখ্যা আড়াই কোটি।
• সুইডেন, ফিনল্যান্ড আর ডেনমার্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। নরওয়ে ই ইউতে যোগ দেয়নি। গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণ থেকে ‘হোম রুল’ পাওয়ার পরে ই ইউ থেকে সরে যায়, এখন সে এই গোষ্ঠীর সহযোগী সদস্য।
• এই দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা অবশিষ্ট ইউরোপের তুলনায় অনেক ভাল। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর সঙ্গের নিবন্ধে রয়েছে। তবে মনে রাখা ভাল, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সব ক’টি দেশ একই নীতি মেনে চলে না। বহু ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রশ্নে প্রতিবেশী দু’টি দেশের নীতিতে বিস্তর ফারাক আছে।

লেখক ওয়াশিংটনে দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে অর্থনীতিবিদ। মতামত নিজস্ব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.