বিজ্ঞানী-গবেষকদের আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। সমীক্ষায় জানা গেল, আর্সেনিক দূষণ থাবা বসিয়েছে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতেও। কানপুর-ইলাহাবাদ থেকে মণিপুরের মায়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে দেশের আর্সেনিক-মানচিত্র!
এবং হিমালয় পর্বতই এই দূষণের উৎস বলে বিশেষজ্ঞমহলের একাংশে সন্দেহ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। তাঁদের মতে, হিমালয়ের নির্দিষ্ট প্রস্তরস্তরে সঞ্চিত আর্সেনিক বিভিন্ন নদীবাহিত হয়ে দেশের বিশাল অংশের ভূস্তরকে গ্রাস করছে। আশির দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে, ও পরে সন্নিহিত বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ জলস্তরে বেশি মাত্রার আর্সেনিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ার পরে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, রাজমহল পাহাড় হল তার উৎস। কিন্তু সাম্প্রতিক সমীক্ষা তিরটা ঘুরিয়ে দিয়েছে হিমালয়ের দিকে।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পূর্ব পাড় বরাবর সাতটি জেলা যে তীব্র আর্সেনিক দূষণের শিকার, নব্বইয়ের দশকে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ-ও জানা যায়, বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ আর্সেনিক-কবলিত। তখন বিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েছিলেন, গোটা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকাই আর্সেনিকে আক্রান্ত। আর তখনই ওঁদের মনে হয়, হিমালয়ের নির্দিষ্ট পাথরের স্তরই তার উৎসস্থল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের গত দশ বছরের সমীক্ষা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ওঁদের অনুমান মোটেই অমূলক নয়। কী রকম? |
বিভিন্ন সমীক্ষার ভিত্তিতে ভারতের যে আর্সেনিক-মানচিত্র তৈরি হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গঙ্গার যাত্রাপথ বরাবর পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড-বিহার-উত্তরপ্রদেশে বিভিন্ন জেলা আর্সেনিক-অধ্যুষিত হয়ে পড়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’ বিহারে গঙ্গার গতিপথ ধরে সমীক্ষা চালিয়ে ১২টি জেলার ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রার বেশি আর্সেনিক পেয়েছিল। ২০০৯-এ তারা গঙ্গার পথ ধরে একই সমীক্ষা শুরু করে উত্তরপ্রদেশে। সম্প্রতি সমীক্ষকদের দাবি: ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকের সন্ধান মিলেছে উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা তীরবর্তী পাঁচটি জেলায় বালিয়া, গাজিপুর, উন্নাও, বারাণসী ও ইলাহাবাদে।
স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধিকর্তা (গবেষণা) দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “প্রথম সমীক্ষায় আমরা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা তীরবর্তী ন’টি জেলায় বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পেয়েছিলাম। পরে ঝাড়খণ্ডের একটা জেলা (সাহেবগঞ্জ) আর্সেনিক-মানচিত্রে ঢোকে। এর পরে বিহারের বারোটা জেলা। এ বার উত্তরপ্রদেশের পাঁচ জেলায় ওই বিপদের সন্ধান মিলল।”
বিপদ-সঙ্কেত পেয়ে এখন কানপুর-ইলাহবাদের আরও উত্তরে, খাস গঙ্গার উৎসমুখে সমীক্ষার তোড়জোড় চালাচ্ছে একাধিক গবেষণা সংস্থা। দীপঙ্করবাবুর কথায়, “আমরা গোমুখ পর্যন্ত যাব। হিমালয়ই যে আর্সেনিকের মূল উৎস, তা এখন শুধু বলার অপেক্ষা। আমাদের ধারণা, গোমুখেও মাটির নীচের জলে আর্সেনিক পাওয়া যাবে।” তিনি জানান, মণিপুরের চার সমতল জেলায়, এমনকী নেপালেও বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের সন্ধান মিলেছে। “আমার বিশ্বাস, হিমালয় থেকে বেরোনো সব ক’টা নদীতেই আর্সেনিক রয়েছে। চিন-তিব্বত-মায়ানমার, সর্বত্র।” মন্তব্য দীপঙ্করবাবুর। তবে নিম্ন গঙ্গা অববাহিকার ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের ঘনত্ব সর্বাধিক বলে তাঁর
দাবি। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এই তল্লাটেই।
একই সূত্রে বিপদের ছায়া ঘনিয়েছে উত্তর-পূর্বে। মণিপুরে আর্সেনিকের উপস্থিতি আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে রুরকির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোলজি’র বিজ্ঞানী-গবেষকদের আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যও এই দূষণে আক্রান্ত হবে। বস্তুত যেখানে যেখানে তা ইতিমধ্যে হানা দিয়েছে বলে
সন্দেহ করা হয়েছিল, সমীক্ষার ফলাফলে তার প্রায় সর্বত্রই আশঙ্কাটি সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। যেমন, অসমের চার জেলায়। এই
রকম নিত্যনতুন পর্যবেক্ষণের
জেরে প্রায় প্রতিটি সমীক্ষার পরে দেশের আর্সেনিক-মানচিত্র পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন
রুরকির বিজ্ঞানীরা।
ভূগর্ভের পানীয় জলে আর্সেনিকের প্রকোপ যে শুধু স্বাস্থ্য-সমস্যার সৃষ্টি করছে, তা-ই নয়। খেতের ফসলেও আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব দেখে গবেষকেরা উদ্বিগ্ন। আর্সেনিক-প্রভাবিত কিছু এলাকায় উৎপন্ন ধান ও বিভিন্ন সব্জিতে বিপদসীমার বেশিমাত্রায় আর্সেনিকের বিষ ধরা পড়েছে। যদিও সঙ্কট প্রতিরোধে তেমন ব্যবস্থা কোথাও গড়ে ওঠেনি বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকের অভিযোগ। দীপঙ্করবাবুর আক্ষেপ, “আমরা কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে বহু দিন আগে হুঁশিয়ার করে বলেছিলাম, আর্সেনিক দূষণের ছবিটা ধীরে ধীরে এমন ভয়ানক চেহারা নেবে। আমরা একা নই। যাঁরা এ নিয়ে সমীক্ষা করছেন, তাঁরাই দূষণের ব্যাপ্তিটা
টের পাচ্ছেন।”
বিপদ আরও ঘনীভূত
হওয়ার আগে কেন্দ্রকে তাই আরও এক বার সতর্ক করে দিয়েছেন দীপঙ্করবাবুরা। |