চলচ্চিত্র বধ্যভূমি! বাস্তব বড় কঠিন। শিল্পকর্মে লব্ধ নয় সেই রূঢ় বাস্তব থেকে উত্তরণ। বড়ই রং-বেরঙের শিল্প চলচ্চিত্র। কোনও একমাত্রিক সমাজ-বিকাশবোধ বোধহয় এই দ্বৈতবাদের জন্ম দেয়। এই মডেল থেকেই অশোক মিত্র লিখলেন, ‘বাজার যখন সুবোধ রায়কে খুঁজে পেল’ (২১-১১)।
যারা বেদব্রতর ছবিটি দেখেছি, তাদের কি আদৌ মনে হয়েছে দিলজাদ অভিনীত ঝুঙ্কু (সুবোধ রায়) ভীষণ রং-বেরঙের? আমরা তো মুগ্ধ হয়েছি এমন এক নিষ্পাপ নতুন মুখ উপস্থাপন করে ঝুঙ্কুর চলচ্চিত্রায়ণে। যার মধ্যে আমরা পেয়েছি শ্রীমিত্র কথিত ‘মুহূর্তের মধ্যে উৎসর্গীকৃত বিপ্লবী সেনানিতে রূপান্তরিত’ কোনও গাথা নয়, পেয়েছি রক্তে-মাংসে গড়া এক সংশয়দীর্ণ বৈপ্লবিক বিবর্তন। একই রকম মানবিক সংশয়-সংবলিত অন্য সব চরিত্রায়ণ।
ক্রেতাদের কাছে যা গ্রহণীয়, সেই নিরিখে সিনেমাটি বানালে পরিচালককে রিলিজের পর এক শহর থেকে আর এক শহরে ঘুরে বেড়াতে হত না। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ঘুরে ঘুরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ইন্টার-অ্যাকশন করতে হত না প্রোমো নিয়ে। অজানা কারণে মাত্র তিন সপ্তাহে মুম্বইয়ের হল থেকে গুটিয়ে নেওয়া হয় শ্রীমিত্র বর্ণিত ‘হালের ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষণীয়’ এই চলচ্চিত্র। দিল্লিতে গুটিকয়েক শো টাইম, তাও ব্লক সিট নিজের পয়সায় কিনে বিনা টিকিটে উন্মুখ ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রদর্শন বর্ধিত করতে হয়। কলকাতার মাল্টিপ্লেক্সে, বেশির ভাগই প্রাইম শো-র টাইম ছাড়াই, চিটাগং-এর পাঁচ-ছয় সপ্তাহ প্রদর্শনের ‘খবরে’ আমরা কিন্তু অন্য চিত্র পেতেই পারি। মাল্টিপ্লেক্সের মধ্যবর্তিতায় সুবোধ রায় কোনও রঙিন হিরো হয়ে ওঠেননি। বরং মুঠো কয়েক জনতা ভাবতে শুরু করেছেন, এমন এক আদর্শনিষ্ঠ মানুষও ছিলেন আমাদেরই মধ্যে প্রচারবিমুখ, একনিষ্ঠ, আত্মত্যাগী। নতুন প্রজন্ম নতুন করে ভাবতে চাইবে সেই ইতিহাসকে যেখানে বিদ্রোহ শেষ কথা নয়। প্রান্তিক কোনও বিদ্রোহ থেকে বৃহত্তর বিপ্লবের পথরেখা তৈরি দেখানোই ছিল চট্টগ্রাম বিদ্রোহের চলচ্চিত্রায়ণ।
আর এটি কি ‘রংচঙে রোম্যান্টিক’ ছবি? বিদ্রোহে প্রেম থাকতে নেই, বিপ্লব চিরধূসর এক আখ্যান। ‘চিটাগং’ ১৯৩০-এর চট্টগ্রাম বিদ্রোহ নিয়ে বেদব্রতর ফিচার ফিল্ম। শিল্পকর্ম। ঐতিহাসিক ঘটনার পুনর্নির্মাণ, শৈল্পিক অভিব্যক্তি-সহ চিত্রনির্মাতার চোখে ইতিহাসের এক অধ্যায়। তাতে দর্শক কি সত্যিই পেয়েছেন ‘রংচঙে রোমান্টিক’ কোনও সিনেমা?
অভিজিৎ কুণ্ডু। অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় |
সুবোধ রায়, চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিদ্রোহের তরুণতম সদস্য, মৃত্যুর দিন অবধি সি পি আই (এম)-এর সদস্য ছিলেন এই ইতিহাসগত সত্যকে বেদব্রত তাঁর ছবির শেষ পর্বে তথ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ভুল করেছেন কি? এখন সি পি আই (এম) এই তথ্যটিকে ব্যবহার করেছে, তারা তো মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্ট্যালিনকেও ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। তার দায়ভাগ কি দ্য ক্যাপিটাল বা হোয়াট ইজ টু বি ডান যাঁরা ছেপেছেন, তাঁদের উপর বর্তায়?
সুবোধ রায়কে যদি নায়ক বানিয়ে বাজিমাতও করতে চেয়ে থাকেন পরিচালক, তা হলেও তো তাঁকে সেলাম জানাতে হয়। ২০১২-য় যুবসমাজের কাছে কাকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরব সেটা তো আসলে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। তাই নয় কি?
আসলে ‘চিটাগং’ ছবির নায়ক চট্টগ্রাম। সাধারণ মানুষের লড়াইও যে লড়াই, স্বল্পস্থায়ী হলেও যে তা সফল হতে পারে, এ ছবি তারই দলিল। তাই ছবি শেষ হয় তেভাগা আন্দোলনের চিত্রায়ণে। নায়ক চট্টগ্রাম তখন গৌণ, লড়াইটাই হয়ে ওঠে নায়ক। নিবন্ধকার লিখেছেন, ছবিটি নাকি বানিয়েছেন মুম্বইয়ের এক ‘বিত্তবান প্রযোজক’, ‘পরিচালকের সনির্বন্ধ অনুরোধে’! শুধু দর্শক হলে এ ছবির পিছনের গল্প আমার জানার কথা নয়। এ ছবির প্রযোজক, পরিচালক নিজেই। এটি সর্বার্থেই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম’, যার বাজেট মাত্র সাড়ে চার কোটি টাকা, যার পুরোটাই এসেছে পরিচালকের পুঁজি ভেঙে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পরে নাসায় সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। একাধিক পেটেন্টের শিরোপা-সহ সফল পেশাদারি জীবন ছেড়ে ব্যাঙ্কে জমানো টাকা তুলে নিয়ে চলে এলেন ভারতে ছবি বানাবেন বলে। এ সব আমি জানতাম না যদি বেদব্রত লস এঞ্জেলেস থেকে ফোন না-করতেন তিন বছর আগে। আমি পর্যটন শিল্পের লোক, চিত্রপরিচালকরা ছবির লোকেশন সন্ধান ও গবেষণার কাজে আমার পরামশর্র্ কেনেন। মুম্বইয়ের শিল্পনির্দেশক সদ্যপ্রয়াত সমীর চন্দের পরামর্শে বেদব্রত আমাকে ফোন করেন একই অনুরোধ নিয়ে। চট্টগ্রাম নিয়ে আশুতোষের ছবিটির তখন শু্যটিং শুরু হয়েছে সম্পূর্ণ এক ভুল লোকেশনে। সুতরাং এটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। বাংলাদেশে শু্যটিংয়ের সমস্যার কারণে চট্টগ্রামকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল অন্যত্র। এ সব কাজের মধ্য দিয়ে কবে যে আমি ‘চিটাগং’-এর দলভুক্ত হয়ে পড়েছিলাম জানি না। আমি কোনও দিন টাকা ছাড়া সিনেমার কাজ করিনি। বেদব্রত চুক্তিমাফিক পুরো পারিশ্রমিক অগ্রিম চুকিয়ে দিয়েছিলেন। সেই আমি এক দিন দেখি, পুরো টাকাটা তাঁকে ফেরত দিয়ে বসে আছি, তাঁর আবেগ আর নীতিসংহতির (‘ইন্টিগ্রিটি’-র বাংলা যদি তাই হয়) কাছে পরাজয় স্বীকার করে। টাকার অভাবে তখন বারবার ছবির কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। ‘প্রযুক্তিগত চতুরালি’-র কথা অশোক মিত্র মশাই খুব ভুল বলেননি। এ ছবিতে এরিক জিমারম্যান, রেসুল পুকুটি, সমীর চন্দ-দের মতো বিশ্বখ্যাত কৃৎকৌশলীরা কাজ করেছেন যে। এটা এখন সবাই জানেন। যেটা জানেন না তা হল, এঁদের অনেকেই কাজ করেছেন অর্ধেক বা বিনা পারিশ্রমিকে। এই নির্মাণের প্রতি একাত্মতাবশত। বাজারি ছবিতে এমন হয় কি?
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের একমাত্র জীবিত চরিত্র বিনোদবিহারী চৌধুরীর বয়স এখন ১০৩ বছর। ছবিটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি একে অসামান্য ঐতিহাসিক ছবি বলেছেন।
শুদ্ধব্রত দেব। চিটাগং চলচ্চিত্রের বহির্দৃশ্য নির্দেশক, কলকাতা-১৩ |
যে সম্মান সুবোধ রায় জীবিত অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পাননি, তাঁকে মৃত্যুর পর সম্মান দিয়ে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন যে পরিচালক শুধু সাধুবাদ নয়, জাতীয় কর্তব্য পালনের জন্য তিনিও সম্মানের পাত্র। চলচ্চিত্রে বরণীয় হয়ে ওঠার পর তাঁর দলের কেষ্টবিষ্টুরা মাল্টিপ্লেক্সে উচ্চমূল্যের টিকিট কেটে দেখছেন এবং অন্যান্য কমরেডকে দেখতে উৎসাহিত করছেন। এটাই তো স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত প্রায়শ্চিত্ত। বরাবরই কমিউনিস্ট পার্টি ভুল বোঝে বিলম্বে, ভুল স্বীকার করে আরও পরে।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানাই। হেয়ার স্কুলে বাংলা পড়াতেন সুধীর ভট্টাচার্য। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে কারাবরণ করেছিলেন। ‘সুপ্রকাশ রায়’ ছদ্মনামে তিনি কৃষক বিদ্রোহ ও গণসংগ্রাম নিয়ে অনেক বই লেখেন। মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী এই শিক্ষকও পার্টির আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে নকশালবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এই ধরনের মানুষেরা আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। তাই এঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। ইতিহাসের মঞ্চে এই ধরনের অনাদৃত নায়ককে যদি যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়, তাতে আপত্তি কেন?
সোমনাথ দে। কলকাতা-৭৩ |