সম্প্রতি গণতন্ত্রের অপার মহিমায় এ দেশে যে কোনও ব্যক্তির হাতে হাতকড়া পরানো একটি অতীব সহজ ঘটনা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ফেসবুক লইয়া উপর্যুপরি যে ঘটনাগুলি ঘটিয়া গেল, তাহা হইতে একটি বিষয় লক্ষণীয়। সাধারণত রাষ্ট্রীয় বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। ফেসবুক উপলক্ষ করিয়া যে কয়েকটি সাম্প্রতিক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটিল, সেগুলি কিন্তু এই সম্ভাবনার বাহিরে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের প্রয়াণের পর মুম্বইবাসীর বিহ্বলতার আতিশয্য দেখিয়া সদ্য-বয়ঃপ্রাপ্ত নাগরিকরা অন্তর্জাল দুনিয়ায় তাঁহাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করিতে গেলে পুলিশ ‘অপরাধী’দের যে ভাবে টানিয়া হিঁচড়াইয়া জেলে পুরিয়াছে, তাহাতে আইনকে পাশ কাটানো হয় নাই, হইয়াছে আইনের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ। অর্থাৎ সাক্ষাৎ আইনটিই এ ক্ষেত্রে সমস্যা। সরকারি কর্তারা ইহার দায় ‘নীচের তলা’র পুলিশের উপর চাপাইতে চাহিতেছেন, কিন্তু তাহা আত্মরক্ষার কৌশলমাত্র। সুপ্রিম কোর্ট এই পুলিশি ‘বাড়াবাড়ি’র জন্য চারটি প্রদেশের (মহারাষ্ট্র, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রশাসিত পণ্ডিচেরি) নিকট হইতে যে ভাবে কৈফিয়ত তলব করিয়াছে, এবং কেন্দ্রীয় ইউ পি এ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ মন্ত্রী কপিল সিব্বল যে ভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের মুখপাত্রদের সহিত বৈঠকে বসিয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছেন, তাহাতে স্পষ্ট, এই আইনটি কতটাই প্রশ্নযোগ্য! বাস্তবিক, আইনটি মানিয়া চলিতে গেলে যে কোনও নাগরিককে যে কোনও দিনই গ্রেফতার করা সম্ভব!
তবে প্রশ্ন এই আলোচনা লইয়াই। আলোচনা এমন একটি বস্তু, যাহা ঠিক সময়ে না সংঘটিত হইলে তাহার মূল্য বহুগুণে কমিয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ২০১২ সালে নহে, এই আলোচনা হওয়া উচিত ছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, যখন সংসদে আই-টি (সংশোধিত) আইনটি প্রথম পাশ হইয়াছিল। তাহার আগে দুই বৎসর যাবৎ তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটি সাংসদ নিখিল কুমারের নেতৃত্বে তদন্ত ও গবেষণা করিয়া প্রচুর সমস্যা ও প্রস্তাব তুলিয়া ধরে। কিন্তু আশ্চর্য, এত জরুরি ও বিশদ একটি প্রস্তাব বিল-আকারে সংসদে উপস্থাপিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই কোনও আলোচনা ব্যতিরেকেই আইন হিসাবে পাশ হইয়া যায়! সংবাদমাধ্যমগুলি তখনই দশ মিনিটে আটটি বিল আইনে পরিণত হইবার এই তাড়াহুড়া, এই সংসদীয় কুকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আই-টি আইনটির মধ্যে প্রথমাবধিই তাই প্রভূত ধোঁয়াশা। নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার গুরুতর প্রশ্নগুলির গভীর ও বিস্তারিত প্রসঙ্গগুলি সবই সেই আইনে অত্যন্ত এলোমেলো ভাবে উপস্থাপিত। ২০০৮ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (সংশোধিত) আইনটির সেই অন্যায় তাড়াহুড়ার খেসারত মিটাইতেছেন আজকের নির্দোষ ভারতীয় নাগরিকগণ।
ঠিক এই কারণেই গণতন্ত্রের বাহ্যিক প্রদর্শন এবং বড়াই-এর বাইরেও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াটি আরও যথাযথ ভাবে পালন করা অত্যন্ত জরুরি। ইহা কেবল প্রগতি ও অধিকারের তাত্ত্বিক প্রশ্ন নহে। রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের প্রাত্যহিক অনুশীলনের সঙ্গে নাগরিকের জীবনের অধিকার ও সুরক্ষার ব্যবহারিক প্রশ্নগুলিও অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। ভারতীয় সাংসদরা সংসদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে পালন না করিলে, আলোচনা ও বিতর্কের পথে আইনের সম্ভাব্য ব্যঞ্জনা বিষয়ে চিন্তাভাবনা না করিলে যে গণতন্ত্রের আদর্শটিও অর্থহীন হইয়া পড়ে, নাগরিকের ব্যবহারিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষার বিষয়টিও বিপন্ন হয়। সিব্বল যখন যুক্তি দেন যে সংসদে আলোচনা না হইলেও তাহার আগে তো বহুস্তরীয় পর্যালোচনা ও কমিটির মধ্য দিয়াই প্রস্তাবটি আসিয়াছিল: তখন তাহার প্রতিযুক্তি হিসাবে বলাই যায় যে, কমিটি দিয়াই যদি সংসদের কাজ চলে, তবে সংসদের প্রয়োজনই বা কী! সংসদের প্রয়োজন এই জন্যই যে সেখানে বিরোধী সমালোচনাগুলি স্পষ্ট শ্রুত হয় এই তর্কবিতর্কের পদ্ধতিগত গুরুত্ব গণতন্ত্রে অসীম। যে কোনও ছুতানাতা কারণে সংসদের কার্যক্রম বানচাল করাই যে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখানে আইনের বিধির মধ্যেও এই চূড়ান্ত অপেশাদারিত্বের প্রকাশ ঘটিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী! |