হুল্লোড়
শীতের সঙ্গে লড়াই জিতবেন কী করে
প্রত্যেক দিন বারোখানা ঘুরন্ত সুচের কামড় খেয়ে শীতের সঙ্গে লড়াই করেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। বিদেশে গিয়ে স্পেশাল সুইডিশ ম্যাসাজ করান মালাইকা অরোরা খান। আর টলিউডের তন্বী সুন্দরী তনুশ্রী চক্রবর্তী করেন সওনা স্পা। শীতের ছোবল থেকে ত্বককে বাঁচাতে, এই ভাবেই সেলিব্রিটিরা দৌড়োদৌড়ি করেন স্পা স্যালোঁ থেকে মেডিকাল হাব। সারা বছর যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও।
এঁদের মতো অত সুযোগ-সুবিধা নেই। কিন্তু সাধারণ কলকাতাবাসী শুধু জ্বর-সর্দি-কাশি নয়, শীতে ত্বকের পরিচর্যা করাতেও দৌড়চ্ছেন বিশেষজ্ঞদের কাছে। চামড়ার ট্যান ওঠাতে, ম্যাজম্যাজে শরীরকে চাঙ্গা করতে তাঁরাও পার্লারমুখী। ম্যানিকিওর, পেডিকিওর, ফেসিয়াল, স্পা, ম্যাসাজ, বাদ নেই কিছুই।
“সারা বছর ধরে ময়শ্চারাইজার লাগালেও শীত পড়লে মাসে অন্তত দু’বার মেডিক্যাল স্পা আর ফ্রুট ফেসিয়াল করি। সঙ্গে ‘ড্যানড্রাফ ক্লিয়ারিং হেয়ার স্পা’। হাজার দুয়েকে হয়ে যায়,” বললেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সৃজনী দে। তবে অভিনেত্রী রাইমা সেনের মতে শুধুমাত্র ত্বকে ময়শ্চারাইজার লাগালে চলবে না, খেয়াল রাখতে হবে হাত-পায়েরও। “হাত-পায়ের নখকে খুব অবহেলা করা হয়। সেটা শরীরের পক্ষে ভীষণ খারাপ। নিয়মিত পেডিকিওর, ম্যানিকিওরটা করাতে হবে,” জানালেন তিনি।
সপ্তাহ-জুড়ে ক্লাস, টিউশন, বাসে-ট্রেনে বাড়ি ফেরা। আর যাঁরা চাকরি করছেন তাঁদের অফিসে চাপ, বাড়ির চাপ সব মিলিয়ে সপ্তাহ শেষে চোখের তলায় কালি। কিন্তু ছুটি নেই। উপায়? এক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা শুভেচ্ছা চট্টোপাধ্যায় বললেন, “শনিবার হাফ-ডে করে সোজা থাই স্পা। পুরো রিল্যাক্সড হয়ে যাই।” আইটি সেক্টরে কাজ করেন মানিকতলার সুলগ্না বসু। রবিবার ছুটি। ওই দিনটা কম্বল মুড়ি দিয়ে না ঘুমিয়ে তিনিও দৌড়ন বাড়ির কাছের স্পা স্যালোঁতে। ওই আলো-আঁধারি সুগন্ধি ঘরটায় সারা সপ্তাহের ক্লান্তি ছুঁড়ে দিয়ে আসা। আবার সোমবার কাজে যাওয়ার জন্য চাঙ্গা। এই ভাবেই ঠিক সময় বের করে নিজেকে পরিচর্যা করছেন সচেতন বাঙালিরা।
সারাদিন ধরে প্রচুর মরসুমি সব্জি আর ফল খেয়ে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা।
ময়শ্চারাইজার লাগানো আর জিম থেকে বেরিয়ে সওনা স্পা। তরতাজা ত্বক। ফুরফুরে মন
মানি স্কোয়্যারের থাই স্পা-এর ম্যানেজার বসুধা শর্মা বললেন, “বেশির ভাগ লোকেরই হাতে সময় নেই। তাই আমরাও মাত্র এক ঘণ্টা বা নব্বই মিনিটের স্পা সেশন রেখেছি। যেমন ‘হট স্টোন থেরাপি’ বা ‘রয়্যাল থাই ম্যাসাজ’। শরীরের পেশিগুলোকে ভোল্কানিক পাথর দিয়ে পরিচর্যা করা হয়। তার পর ম্যাসাজ। যা টিস্যু থেকে টক্সিন বের করে দেয়। খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে শুরু।” স্পা বা ম্যাসাজ করাটা আর শৌখিনতা নয়। সেগুলো শরীরের অপরিহার্য চিকিৎসা। তাই খরচ করতে একটুও কার্পণ্য করছে না বাঙালি সমাজ।
“শীতকালে আমার সারা গায়ে হাত-পায়ে গুটির মতো বেরোতে থাকে। চামড়া খসখসে হয়ে বিশ্রী দেখায়। তাই শীতটা পড়লেই আমি একটা রবিবার দেখে রাজারহাটের ‘বেদিক ভিলেজ’-এ গিয়ে একটা ‘হানি-ইয়োগার্ট বডি র্যাপ’ নিই। স্ক্রাবিং, ম্যাসাজিং, বডি প্যাক। এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের প্যাকেজ। খরচ সাড়ে তিন হাজার। ত্বকের স্ক্রাবিং আর এসেনশিয়েল অয়েল দিয়ে বডি পলিশিং। দু-তিন দিনের মধ্যে আমার ওই গুটি মিলিয়ে যায়। তাই শীতে ওটা মাস্ট,” জানালেন বছর তিরিশের সৌমিলি চট্টোপাধ্যায়। সৌমিলির মতো অনেকেই শীতকালে হাজার একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হন এই ‘বেদিক ভিলেজ’-এ। শীতের চোটে কারও ত্বকের কুঞ্চন বেড়ে গিয়েছে তো কারও শরীরে ময়লা জমে কালো ছোপ পড়ে গিয়েছে বা রোদে পুড়ে ত্বক তামাটে হয়ে গিয়েছে। “বিভিন্ন প্রবলেমের জন্য আমরা বিভিন্ন স্পা সাজেস্ট করি। যেমন রোদে-পোড়া ত্বকের জন্য ‘অরেঞ্জ বডি র্যাপ’, তেলতেলে ত্বকের ঝামেলায় করবেন ‘অ্যালো ফ্রুট ফেসিয়াল’ আর ‘অ্যালো ফ্রুট র্যাপ’। প্রত্যেকটাই এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের। খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা,” জানালেন ‘বেদিক ভিলেজ’-এর সঞ্জীব স্পার ডিরেক্টর ডঃ কৃষ্ণ জনার্দন।
আমরা কী করি
সারা বছর ধরেই ময়শ্চারাইজার লাগাই।
শীতকালে নিয়মিত
ম্যানিকিওর-পেডিকিওর করি।
রাইমা সেন
সপ্তাহে তিন-চারবার হার্বাল স্পা করাই।
আর মুখের জেল্লা ধরে রাখতে মাখি
অ্যাপ্রিকট কার্নেল অয়েল।
ক্যাটরিনা কইফ
প্রত্যেক দিন কোল্ড ক্রিম লাগাই আর
তিন দিন অন্তর আয়ুর্বেদিক স্পা করাই।
সঙ্গে ময়শ্চারাইজার।
মালাইকা অরোরা খান
ডার্মারোলার দিয়ে ত্বকের উপর মৃত
কোষের স্তর সরাই। তার পর
ময়শ্চারাইজিং মিল্ক লাগাই।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
কিন্তু শুধু ত্বকের পরিচর্যাই নয়, শীতকালীন ব্যথা বা যন্ত্রণাতেও ভোগেন অনেকেই। বেশির ভাগেরই বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ। নতুন চাকরি পেয়েছেন। কিংবা সারাদিন ইউনিভার্সিটি-টিউশন-কাজের চাপে দম ফেলার সময় পান না। নিজেদের ফিট রাখতে এঁরাও কিন্তু দৌড়চ্ছেন ম্যাসাজ করাতে, স্টিম বাথ নিতে, বা সওনা, স্পা করাতে। চাই ত্বকের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে মানানসই ফিটনেস। অ্যারোমাথেরাপিস্ট কেয়া শেঠকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, “২০ থেকে ২৫ বছরের বহু ছেলেমেয়ে আসে, যাদের এই বয়সেই গাঁটের যন্ত্রণা, আর্থ্রারাইটিস, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা। শীতকালে এগুলো বাড়ে। এদের জন্য আছে ‘অভ্যাঙ্গম’। ৪৫ মিনিটের সেশনের খরচ ১৮০০ টাকা। আর আছে ‘ডি-স্ট্রেসিং ম্যাসাজ’। শরীরের টক্সিন বের করে দিয়ে পুরো শরীরটা ঝরঝরে করে দেয়। নব্বই মিনিটের ম্যাসাজ করাতে খরচ পড়বে আড়াই হাজার টাকা।” তাঁর থেকেই জানলাম যে অনেকেই আসেন শুধুমাত্র রিল্যাক্স করার জন্য। তাঁরা সম্পূর্ণ বডি স্পা করে যান। আসেন আরও একদল মানুষ যাঁরা ম্যাসাজের সাহায্যে শীতকালীন মেদ ঝরিয়ে হয়ে উঠতে চান ‘ফ্যাব’। তাঁদের জন্য ‘ইলাকিজি ম্যাসাজ’। এতে শুধু পলিশিং বা রিল্যাক্সেশনই হয় না, চেহারায় একটা শেপও আসে। সাত দিনের প্যাকেজে খরচ পড়বে সাত হাজার টাকা।
শুধু মহিলারাই নন, নিজের পরিচর্যা করতে এই শীতে কিন্তু পিছিয়ে নেই পুরুষেরাও। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়া সায়ক সেন তো শীতকালে প্রত্যেক রোববার ম্যাসাজ করান পাড়ার সেলুনে। “সারা সপ্তাহ প্র্যাকটিক্যাল, টিউটোরিয়ালের খাটনি, ম্যাসাজ না করালে গা হাত-পায়ে এত যন্ত্রণা করে যে উঠতে পারি না”, জানালেন তিনি। সেলসে চাকুরিরত সায়ন্তন মজুমদারের অবশ্য অন্য চাহিদা। রোদে পোড়া ত্বকে জেল্লা ফেরাতে তিনি উইক্এন্ডে ঘুরে আসেন ‘বেদিক ভিলেজ’। ওখানকার ‘ডেড সি মাড স্পা’ করান। যেটা ত্বকের তিনটে স্তর ভেদ করে জমা তেলে বন্ধ রোমকূপগুলো পরিষ্কার করে। একই সঙ্গে স্ক্রাবিং আর ম্যাসাজিং। ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালনও হল আবার মৃত কোষ উঠে যাওয়ায় ত্বকে এল একটা গ্লো। দু’ ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের এই সেশনটার দাম সাত হাজার টাকা।
ফাটা কেষ্ট
ব্যায়াম করা আর জল খাওয়ার
পরিমাণটা বাড়ানো ছাড়া
আর কিচ্ছু করি না।
রণবীর কপূর
ফেসিয়াল বা স্পা কোনওটাই করি না।
মুখ-টুখ ফাটলে কোল্ড ক্রিম
বা ময়শ্চারাইজার লাগাই।
দেব
মোমবাতি-ঘেরা আলোয় সুগন্ধি একটি ঘর। পালকের মতো নরম বিছানা। সঙ্গে হাল্কা মিউজিকের তালে তালে এক্সপার্টের হাতে ম্যাসাজ নেওয়া। “আরামে ঘুম পেয়ে যায়। উঠতেই ইচ্ছে করে না,” মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বললেন কলেজপড়ুয়া দেবস্মিতা সরকার। আলস্য হোক বা শরীরের ফাটলশীত নামক দস্যুকে দমন করতে এখনকার যুবসমাজ অনেকটাই বেশি সক্রিয়। অনেকটাই সচেতন। নিজের শরীরের চাহিদাটা তাঁরা বোঝেন এবং সেইমতোই চিকিৎসা করান।
কিন্তু এই শীতকালীন পরিচর্যা করতে খরচা আছে। এবং খুব নামী-দামি জায়গায় ঘণ্টাপিছু হাজারখানেক টাকা খরচা করতে এখনও বেশ খানিকটা দোনোমোনো করেন অনেকেই। এঁরা বেশির ভাগই কলেজপড়ুয়া বা ২০-২৫ বছরের মধ্যে। যারা এখনও টুকটাক কাজ বা পকেটমানি দিয়েই কাজ চালায়। বা সবে কাজে জয়েন করেছে। তাদের কিন্তু অনামী পার্লারই ভরসা। সেখানেই তাঁরা পেয়ে যাচ্ছেন নিজের পকেট আর চাহিদা অনুযায়ী ‘উইন্টার প্যাকেজ’। ব্যারাকপুরের পূজা রায়চৌধুরী শীত কাল পড়লেই আপাদমস্তক ট্রিটমেন্ট করাতে মাসে অন্তত দুটো রবিবার পুরো দুপুরটা কাটান বাড়ির পাশের পার্লারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর মতে, “সারা সপ্তাহ ধরে ক্লাস করে রবিবার আর কলকাতা যেতে ইচ্ছে করে না। তাই এখানেই করাই।” কিন্তু এই ‘কম দামি’ পার্লারে স্পা করাটা কতটা নির্ভরযোগ্য? “ভালই করে এখানে, খরচও কম। আমার তো কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে নামী স্যাঁলোতে করাতে না পারলে শুধু দেখে নিতে হবে যে ব্যবহৃত ক্রিম, তোয়ালে বা ম্যাসিওরের হাত পরিষ্কার কি না। তাহলেই আর কোনও চিন্তা থাকবে না,” বললেন পূজা।
তিনিই বলে দিলেন কোন ম্যাসাজে বা কোন স্পা-তে কী ফল হয়। তাঁর মতো কলকাতার বেশির ভাগ লোকই এখন নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে এতটাই ওয়াকিবহাল। তাই শুধু টিভির পর্দায় শীতকালেও কেট উইনস্লেটের নিখুঁত ত্বক বা ক্যাটরিনার গ্ল্যামার দেখে হা-হুতাশ করা নয়। হিংসেতে জ্বলাও নয়। এই শীতে চেষ্টা নিজেকে আদর-যত্ন দিয়ে প্রসাধন করা। এর পর এ বারের শীতের রুক্ষতাকে ‘বোল্ড আউট’ করে আপনিও পাল্লা দেবেন ‘মৎস্যকন্যা’ তনুশ্রীর জেল্লাকে।

মডেল: তনুশ্রী চক্রবর্তী; ছবি: ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়; লোকেশন: সুইসোটেল কলকাতা নেওটিয়া ভিস্তা
ফটোশ্যুট পরিচালনা: রূপা গঙ্গোপাধ্যায়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.