বেড়েছে সংখ্যায়, মানে নয়।
নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিষেবায় গত এক বছরে এ রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রশংসা পেয়েছে দিল্লিতে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তা ও চিকিৎসকদের বৈঠকে বলা হয়েছে, অন্য যে কোনও রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে গত এক বছরে অনেক বেশি ‘সিক নিউ বর্ন ইউনিট (এসএনসিইউ)’ গড়ে উঠেছে। কিন্তু সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থেকেও পরিকাঠামোয় পিছিয়ে থাকার কথা মানতেই হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে।
নবজাতকদের চিকিৎসার ওই ইউনিটগুলিতে চিকিৎসকদের অবস্থা বহু ক্ষেত্রেই নিধিরাম সর্দারের মতো। নেই চিকিৎসার অনেক জরুরি সরঞ্জামই। তাঁদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পরিকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্র বরাদ্দ করেছে ১০ কোটি টাকা। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা মনে করছেন, এই টাকায় মাস কয়েকের মধ্যেই তাঁরা পরিকাঠামোর খামতিগুলি পূরণ করে নিতে পারবেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে সিক নিউ বর্ন ইউনিটের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু সেই সব ইউনিটে প্রায় কোথাওই ভেন্টিলেটর নেই। নেই রুগ্ণ নবজাতকের চিকিৎসার জন্য জরুরি সিপ্যাপ (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ার প্রেশার) যন্ত্রও। অবিলম্বে সেগুলো কেনার কথা বলা হয়েছে।”
নবজাতকদের চিকিৎসা ইউনিটগুলিতে পরিকাঠামোর অভাবের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাও। এমনকী পুরুলিয়া হাসপাতালের যে এসএনসিইউ ‘পুরুলিয়া মডেল’ নামে দেশের বাইরেও স্বীকৃতি পেয়েছে, সেই মডেল নিজেই ধুঁকছে, মেনে নিয়েছেন তাঁরা। রাজ্যের এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, “শয্যা বাড়েনি, একে একে বেশ কিছু যন্ত্র খারাপ হয়েছে। মেরামতির ব্যবস্থা হয়নি। আসেনি আধুনিক কোনও সরঞ্জাম। ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার ২০০৬ সাল থেকে অকেজো। ভেন্টিলেটর নেই। এমনকী, কম ওজনের শিশুকে বাঁচাতে সিপ্যাপ নামে যে যন্ত্রটি খুবই জররি, তা-ও দেওয়া হয়নি এই কেন্দ্রকে। এত দিনেও চালু করা যায়নি কোনও নিওনেটাল ওয়ার্ড। যে শিশুরা এসএনসিইউ-এ ঠাঁই পায় না, তাদের পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেই ওয়ার্ডে বহু সময়েই একই শয্যায় একাধিক শিশুকে রাখতে হয়। এর জেরে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় থাকে।” |
রাজ্যে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এসএনসিইউ-এ এনে রুগ্ণ বাচ্চাকে কোনও মতে হয়তো বাঁচানো গেল, কিন্তু তার পর তারা কোথায় যাবে? সেই জন্যই শয্যা সংখ্যা বাড়ানো দরকার। শুধু পুরুলিয়া নয়, সর্বত্রই। এমনকী শহরের হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোও যথেষ্ট নয়। তাই সে ক্ষেত্রেও আমরা কিছু বদল আনছি।”
স্থির হয়েছে, কেন্দ্রের দেওয়া ১০ কোটি টাকায় প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজের জন্য ৪টি করে মোট ৫২টি ভেন্টিলেটর এবং ৫টি করে অর্থাৎ ৬৫টি সিপ্যাপ যন্ত্র কেনা হবে। পাশাপাশি শয্যা সংখ্যা বাড়ানো এবং জরুরি মেরামতির কাজও হবে ওই টাকায়। ত্রিদিববাবুর দাবি, বছরের পর বছর এ রাজ্যে নবজাতকের চিকিৎসার কোনও পরিকাঠামো ছিল না। গত এক বছরে ধাপে ধাপে কাজ হচ্ছে। তিনি বলেন, “কলকাতার বাঙুর হাসপাতালে এসএনসিইউ হয়েছে। বি সি রায় হাসপাতালেও পরিকাঠামো ধাপে ধাপে অনেকটাই বেড়েছে। শুধু বি সি রায়েই নবজাতকদের জন্য ২১০টি শয্যা। একই হাসপাতালে নবজাতকদের জন্য এমন ব্যবস্থা দেশের আর কোনও হাসপাতালে নেই।”
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, বি সি রায়ের এই নজির ছড়িয়ে পড়া উচিত অন্যত্রও। তাই শুধু কলকাতা নয়, দেশের অন্য বড় শহরগুলিতেও তাঁরা নবজাতকদের চিকিৎসা পরিকাঠামো বাড়ানোর ব্যাপারে সহায়তা করতে চান। গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের ধাঁচে তাই এ বার শহরেও ‘জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য মিশন’ চালু করা হবে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, “অপুষ্ট মা ও শিশু নিছক গ্রামীণ সমস্যা নয়। শহরেও বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। শহরেও বহু মহিলা প্রসবকালীন পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হন। চিকিৎসার অভাবে শহরেও মৃত্যু ঘটে বহু নবজাতকের।” মা ও শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষায় ২০০৫ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছিল জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন। দেশ জুড়েই এই প্রকল্প যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সার্বিক ভাবে শিশুমৃত্যুর হার তেমন কমানো যায়নি। শহরাঞ্চলকে এই ধরনের প্রকল্পের আওতার বাইরে রাখাই এর অন্যতম কারণ বলে মেনে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা। সেই কারণেই শহরে নবজাতক স্বাস্থ্য মিশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কলকাতা, মুম্বই, নয়াদিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, আমদাবাদ-সহ মোট ৭৭৯টি শহরের দারিদ্রসীমার নীচের প্রসূতি ও শিশু এই পরিষেবার আওতায় আসবেন। |