দেওয়ালে আঁকাবাঁকা ফাটল। লেবার রুমের চাঙড় খসে পড়ছে। সদ্য দায়িত্ব নিয়ে খড়িপুকুরিয়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দশা দেখে চোখ কপালে ওঠে তরুণ চিকিৎসক বিক্রম পণ্ডার। জেলা স্বাস্থ্য দফতরে আবেদন জানিয়ে লাভ হয়নি। তাই জানান জেলাশাসক, সাংসদকে। শেষ অবধি চিঠি লেখেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে। এর পরেই শো-কজ চিঠি এসেছে জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছ থেকে। উপরমহলে তদ্বির করার জন্যই এই হয়রানি, বলছেন কাঁথি ৩-এর বিএমওএইচ বিক্রমবাবু। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি মামুদ হোসেনের অভিযোগ, হাসপাতালের হাল না ফিরিয়ে বিক্রমবাবুকে ‘বলির পাঁঠা’ করছে স্বাস্থ্য দফতর।
কেন শো-কজের চিঠি? জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কালিদাস দত্ত বলেন, “বিক্রমবাবু জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে এড়িয়ে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু কাজ করায় শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য তাকে শো-কজ করা হয়েছে।” তাঁর চিঠির বয়ান অবশ্য বলছে, জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের অনুমতি না নিয়ে স্বাস্থ্য ভবন যাওয়া “উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি ইচ্ছাকৃত আনুগত্যহীনতা” বলে মনে করছেন কালিদাসবাবু। সদ্য কাজে যোগ-দেওয়া চিকিৎসকের থেকে এই ব্যবহার প্রত্যাশিত নয়। তাই তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে হবে, কেন কর্তৃপক্ষ বিক্রমবাবুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না চিঠিতে এমনই লিখেছেন কালিদাসবাবু। |
সম্প্রতি জেলাসফরে গিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যে কোনও বিষয়ে তাঁর কাছে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। বিক্রমবাবুর অভিযোগ, সেই পথে হেঁটেই ফাঁপরে পড়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “সরাসরি উপরমহলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্যই বিভিন্ন ছুতোতে হেনস্থা করা হচ্ছে।” কালিদাসবাবুর বক্তব, “ওঁর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করব না।” ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের’ চিঠি হাতে হাতে মিললেও, দীর্ঘদিন ধরে বেহাল কাঁথি ৩ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বছর দুই আগে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে ৩০ শয্যার গ্রামীণ হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন ভবনের শিলান্যাস হয়। সেই কাজ শুরু হওয়া দূরের কথা, জীণর্র্ ভবনটিরও সংস্কার করা হয়নি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ‘লেবার রুমে’ ছাদের চাঙড় ভেঙে পড়ছে। ডিসপেন্সারির দেওয়াল জুড়ে ফাটল। সাপ-খোপের আস্তানা চারদিকে। বাইরে পানীয়জলের কলগুলি ভাঙা। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তৈরি সরকারি আবাসনগুলি ভগ্নপ্রায়। সেখানে কেউ থাকেনও না।
কী বলছেন এলাকার মানুষ? খড়িপুকুরিয়া গ্রামের জহর গিরি, নন্দ জানা, পানিচিয়াড়ী গ্রামের ঝাড়েশ্বর গিরি, ভাঁইটগড়ের শেখ ওসমানরা জানান, এক সময় এলাকার লোকজন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছায়া না মাড়াতেন না। বছর দুয়েক আগে দুই চিকিৎসক যোগ দিলে পরিস্থিতি কিছু বদলায়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের দায়িত্ব নেন বিক্রমবাবু। তাঁকে উদ্যোগী হতে দেখে আশার আলো দেখছেন তাঁরা।
কাঁথির পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের, জেলা পরিষদও তাই। সেখানকার নেতারা কিন্তু বিক্রমবাবুর বক্তব্যকেই সমর্থন করছেন। জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি মামুদ হোসেন বলেন, “দু’বছরে একটা ইঁটও গাঁথা হয়নি ওই গ্রামীণ হাসপাতালে। কার্যত বেহাল অবস্থায় পড়েছিল ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ওই তরুণ চিকিৎসকের উদ্যোগ দেখে আশেপাশের মানুষ ফের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভিড় করছেন। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্মকর্তারা প্রকৃত সমস্যার সমাধান না করে শোকজ চিঠি ধরিয়ে তরুণ চিকিৎসককে বলির পাঁঠা করতে চাইছেন।” কাঁথি ৩ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অর্ধেন্দু পণ্ডা বলেন, ব্লক স্বাস্থ্য সমিতি ও রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে ওই আবাসনগুলিকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার কথা বলা হলেও স্বাস্থ্য দফতর ব্যবস্থা নেয়নি। তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারীও বলেন, “ওই ভবনের কাজ কেন হচ্ছে না তা অনেকেই আমার কাছে জানতে চায়। আমি বিষয়টা দেখতে বলেছি।”
জেলাশাসক পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকির আশ্বাস, “কোনও সরকারি আধিকারিক যদি মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তা হলে অসুবিধাটা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছি না। জেলাশাসক হিসেবে সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত।”
আপাতত শো-কজের জবাব নিয়েই ভাবছেন উদ্যমী এই তরুণ চিকিৎসক। |