কুষ্ঠ রোগীদের অচ্ছুত করে রাখার বিরুদ্ধে সরকারি প্রচারে খরচ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বার-বার বলা হয়েছে, বেশির ভাগ কুষ্ঠই ছোঁয়াচে নয়। কিন্তু ফল হয়েছে কতটা? দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ দূরের কথা, খোদ সরকারি চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিকতাই বদল করতে পারেনি ওই প্রচার। তার ফলে রাজ্যে কুষ্ঠ রোগীদের অস্ত্রোপচার কার্যত বন্ধ হওয়ার মুখে।
সময়ে অস্ত্রোপচার না হলে কুষ্ঠ রোগীরা স্থায়ী ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যান। অস্ত্রোপচারের আগে-পরে ফিজিওথেরাপিও বাধ্যতামূলক। অথচ পরিস্থিতি এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, কুষ্ঠ রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য রাজ্যে দরকার যেখানে অন্তত ৩০ জন সার্জন, সেখানে রয়েছেন মাত্র ৪ জন। ফিজিওথেরাপিস্ট দরকার ৪০ জনের মতো। রয়েছেন মাত্র ১ জন। এই তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের কুষ্ঠ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম অধিকর্তা প্রদীপকুমার মণ্ডল। তিনি এ কথাও জানিয়েছেন যে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও কুষ্ঠ রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। প্রদীপবাবুর কথায়, “কুষ্ঠ রোগীকে অচ্ছুত করে রাখার প্রবণতা রয়ে গিয়েছে অনেক চিকিৎসক ও নার্সের মধ্যেও। এটা দুর্ভাগ্যের। অধিকাংশ চিকিৎসককে কুষ্ঠ রোগীর অস্ত্রোপচারে আগ্রহী করতে পারছি না।”
স্বাস্থ্যকর্তার দেওয়া হিসেব থেকেই রাজ্যে কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসার হাল স্পষ্ট। একই সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, সচেতনতা নিয়ে সরকারি ঢক্কানিনাদ কতটা অসার। অথচ এই প্রকল্পে টাকার কোনও অভাব নেই বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্তারাই। প্রদীপবাবু বলেন, “ডাক্তারদের কুষ্ঠ রোগীদের অস্ত্রোপচারে রাজি করতে পারছি না। প্রতি বছরই কেন্দ্র আমাদের ১৫ থেকে ১৭ লক্ষ টাকা দেয় কুষ্ঠ রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য। এই অস্ত্রোপচারের পর দারিদ্রসীমার নীচে থাকা রোগীকে টাকাও দেয় কেন্দ্র। সেই টাকারও একাংশ পায় হাসপাতাল। ওই টাকা বছরের পর বছর খরচ হচ্ছে না।”
|
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে চিকিৎসক-নার্সদের সচেতনতার এই হাল কেন?
বাম-ডান উভয় চিকিৎসক সংগঠনই জানাচ্ছে, মানসিকতাটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিজে থেকে না চাইলে এর পরিবর্তন হওয়া মুশকিল। বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’ এবং তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’, দু’পক্ষই বলছে, মেডিক্যাল কোর্সেই সব রোগ সম্পর্কে বলা আছে। সে সব পড়ার পরে ডাক্তারদের ভয় পাওয়ার কথা নয়। তাই আলাদা করে ওয়ার্কশপের কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা ভাবা উচিত।
যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই সার্জন এবং প্লাস্টিক সার্জনরা অবশ্য ছোঁয়াছুঁয়ির প্রসঙ্গ উড়িয়ে অন্য কারণ দেখিয়েছেন। এসএসকেএম হাসপাতালের এক প্লাস্টিক সার্জন বলেন, “কেস রেফার হয়ে আমাদের কাছে এলে তবে তো অস্ত্রোপচার করব। কুষ্ঠ বিভাগে চিকিৎসক এত কম যে জেলা থেকে রোগী রেফার করার লোক পাওয়া যায় না।” আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের এক প্লাস্টিক সার্জনের আবার যুক্তি, “কুষ্ঠ রোগীর অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জনদের আলাদা প্রশিক্ষণ দরকার। সেটা দেওয়া হয় না। রোগীর চাপ সামলে আলাদা করে কুষ্ঠ রোগীদের আস্ত্রোপচার করতে হলে সার্জনদের আলাদা উৎসাহ-ভাতাও দেওয়া উচিত। নয়তো সার্জনরা উৎসাহ দেখাবেন না।”
মেডিক্যাল কলেজের এক প্লাস্টিক সার্জন আবার বলেছেন, “জেলার অধিকাংশ কুষ্ঠ রোগী জানেনই না কোথায়, কখন, কী ভাবে অস্ত্রোপচার করাতে হবে। সচেতনতার অভাবটাই সব সমস্যার মূলে।”
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের এক প্লাস্টিক সার্জনের বক্তব্য, “কুষ্ঠ রোগী প্রতি বছর পাওয়া যাচ্ছে, তা সত্ত্বেও কোনও হাসপাতালে কুষ্ঠ রোগীদের আলাদা ওয়ার্ড নেই। বাঁকুড়ার গৌরীপুরে কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আলাদা কেন্দ্র ছিল। তা-ও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। পরিকাঠামো ঠিক না হলে অস্ত্রোপচার বাড়বে না।” |