বছর ঘুরলেও ‘রহস্যই’ থেকে গেল করলা নদীর বিষ-কাণ্ড। দূষণ মুক্ত করতে করলা নদী সংস্কার করার কথা রাজ্য সরকার ঘোষণা করলেও সেই কাজও শুরু হয়নি। কবে সেই কাজ শুরু হবে তা আজও স্পষ্ট নয়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য দাবি করেছেন, বিশদ সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে বলেও মন্ত্রী দাবি করেছেন। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর জলপাইগুড়ি শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করলা নদীতে বিষক্রিয়ায় হাজার হাজার মৃত মাছ ভেসে ওঠে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ঘটনার তদন্ত করানোর নির্দেশ দেন। সেই মত মৎস্য দফতরের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে জেলা পুলিশ। ফরেন্সিক বিভাগ এবং পরিবেশ দফতর উভয়ই জলের নমুনা পরীক্ষা করে জানায় নদীতে প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ কীটনাশক মিশে যাওয়ায় জলপাইগুড়ি শহর এবং লাগোয়া এলাকার প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদীর জল বিষিয়ে যায়। কিন্তু কে বা কারা এই বিষ কীটনাশক নদীতে মিশিয়েছে, বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি পুলিশ-প্রশাসন। যদিও ঘটনার মাস দুয়েক পরে শহরের ইন্দিরা কলোনি এলাকায় নদীতে ধান চাষ করার অভিযোগে এক বৃদ্ধ কৃষককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। যদিও পুলিশের এই তত্ব মানতে চায়নি মৎস্য এবং কৃষি দফতর। দফতর থেকে জানানো হয়, এক বিঘারও কম পরিমাণ জমিতে চাষ করা ধানে যে পরিমাণ এন্ডোসালফান মেশানোর কথা তাতে পুরো নদী বিষিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। |
পুরসভার তরফে মাছের চারা ছাড়া হল করলা নদীতে। বুধবার সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
মৎস্য দফতরও জানায় নদীর মাঝামাঝি এলাকায় ধান চাষ হয়েছিল। কিন্তু বিষক্রিয়া হয়েছে পুরো নদী জুড়েই, যা সম্ভব নয়। পরে পুলিশও ওই রিপোর্ট প্রশাসনের কাছে আর পাঠায়নি। বর্তমানে কি অবস্থায় রয়েছে তদন্ত প্রক্রিয়া? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নিষিদ্ধ এণ্ডোসালফান মিশে যাওয়ার প্রমাণ মেলার পরে কোথায় নিষিদ্ধ কীটনাশকের কেনাবেচা হয় তার খোঁজ খবর করা হয়। শহর লাগোয়া যে সব চা বাগানের পাশ দিয়ে করলা নদী বয়ে গিয়েছে সেখানেও তদন্ত চালায় পুলিশ। চা বাগানে ব্যবহার করা এণ্ডোসালফান একসঙ্গে বেশি পরিমাণে নদীতে পড়ে গিয়েও মাছের মড়ক হতে পারে বলে পুলিশের তরফেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর পরে আর তদন্ত এগোয়নি। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, “বিশদে খোঁজখবর নিয়ে যা বলার বলব।” এদিন জেলাশাসকের দফতর থেকেও জানানো হয়েছে এ বিষয়ে কোনও তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়েনি। মৎস্য দফতরের জেলা আধিকারিক পার্থপ্রতিম দাস বলেন, “বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি যে কেন নদীতে বিষ মিশল? কে মেশাল সেটা আমাদের জানা নেই।” তদন্তের মতোই থমকে রয়েছে নদীকে দূষণ মুক্ত করার কাজও। বিষকাণ্ডের তিন দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান বিনয় দত্ত, সঙ্গে ছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রও। সেদিনই জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসে সকলকে নিয়ে বৈঠক করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। করলা নদীকে দূষণমুক্ত করতে সেচ দফতর কাজ শুরু করবে বলে রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়। যদিও ঘটনার এক বছর পার হলেও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। নদী সংস্কারের বিস্তারিত পরিকল্পনা তথা ডিপিআর তৈরি করতেই ৬ মাস কেটে যায় বলে জানা গিয়েছে। এর পরে গত জুন মাস নাগাদ প্রায় ২৩ কোটি টাকার পরিকল্পনা তৈরি করে জেলা সেচ দতর থেকে রাজ্যের কাছে পাঠায়। প্রকল্পের অর্থ কমানোর কথা বলে সেই প্রকল্প ফের জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে গত অগস্ট মাসে খরচের কাটছাট করে প্রায় ১৬ কোটি টাকার পরিমার্জিত ডিপিআর রাজ্যকে পাঠানো হয়। ডিপিআর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর থেকে রাজ্যের পরিকল্পনা দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদনও এখনও মেলেনি। সেই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে টেন্ডার করে কাজ শুরু করতে নুন্যতম ৬ মাস প্রয়োজন বলে প্রশাসনিক মহলই মনে করছে। ডিপিআর তৈরি হয়ে যাওয়ায় দ্রুত সংস্কার কাজ শুরু হবে বলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব সম্প্রতি কে সভায় আশ্বাস দিয়েছেন। সেচ দফতরের জলপাইগুড়ির নির্বাহী বাস্তুকার অসীম চৌধুরী বলেন, “বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। কাজ শুরু হতে আর বেশি সময় লাগবে না। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা হয়।” |