দলমার হাতির যাত্রাভঙ্গ করতে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের সীমানা বরাবর খাল কেটেছিল ওড়িশা সেচ দফতর। পোশাকি নাম ‘সেচ খাল’। কিন্তু তাতেও আটকানো গেল না তাদের। সাময়িক বাধা পেলেও ‘বিকল্প পথ’ খুঁজে নিয়ে দলপতি ‘দাঁতাল’কে অনুসরণ করে হাতির পাল এখন ওড়িশায় বনাঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, সোমবার প্রায় ১২০টি হাতির পাল নয়াগ্রামের ধুমসাই জঙ্গল হয়ে ওড়িশায় ঢুকে পড়েছে। এ বার ওড়িশায় ঢুকতে জঙ্গলে প্রায় দশ কিমি পথ ঘুরতে হয়েছে হাতিদের। খড়্গপুরের ডিএফও অঞ্জন গুহ বলেন, “হাতির পালটি ওড়িশার দিকে গিয়েছে। পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হচ্ছে।”
রাজ্য বন দফতর সূত্রের খবর, গত বছর হাতির পাল ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ বন্যপ্রাণ বিভাগের অন্তর্গত বেতনটি বনাঞ্চলে ঢুকে মাস খানেক ছিল। ফলে ওড়িশার ওই এলাকায় লোকালয়ে হাতির হানায় ফসল ও সম্পত্তির ভালই ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর এতেই উদ্বিগ্ন হয়ে এলাকায় হাতির ঢোকা আটকাতে তড়িঘড়ি ওই খাল কাটা হয় বলে এলাকাবাসীর একাংশের দাবি। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ওড়িশার সেচ দফতর ও ময়ূরভঞ্জ বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ।
গত ৭ ও ১৪ নভেম্বর দু’দফায় দু’টি দলে ভাগ হয়ে চাঁদড়ার দিক থেকে কলাইকুণ্ডা হয়ে আসা হাতির পালটি সুবর্ণরেখা পেরিয়ে নয়াগ্রামে ঢোকে। কিন্তু নয়াগ্রামের চাঁদাবিলা বনাঞ্চল হয়ে ওড়িশার দিকে যেতে বাধা পায় তারা। ২০-২৫টি শাবক নিয়ে বাধা পেয়ে হাতিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে পালের গোটা কুড়ি হাতি কলাইকুণ্ডা হয়ে চাঁদড়ার দিকে ফিরেও যায়। তবে বাকি দলটি হাল ছাড়েনি। গত বছর নয়াগ্রামের জরিঘাটি হয়ে হাতিরা ওড়িশায় ঢুকেছিল। এ বার ঘুরপথে ধুমসাইয়ের পূর্ব-জঙ্গল হয়ে হাতিরা ওড়িশায় গেল। এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, ওড়িশার খুঁটাপালের কাছে খালটির গভীরতা কম। চতুর হাতিরা গত ১০-১২ দিন ধরে পর্যবেক্ষণের পর শাবক-সহ খাল পেরনোর উপযুক্ত পথের সন্ধান করে নেয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওড়িশার দিক থেকে বেতনটির বনকর্মীরা হাতির পালকে ফের নয়াগ্রামে পাঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সফল হননি।
পরিসংখ্যান বলে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর শীতের মরসুমে হাতির পাল নয়াগ্রামে আসে। আকর্ষণ, সুবর্ণরেখার চরে হওয়া প্রচুর আখ ও শীতকালীন সব্জি চাষ। এছাড়া বিস্তীর্ণ খেতে ধানচাষও হয়। ফলে হাতির হানায় ফি বছরই কয়েক লক্ষ টাকার ফসল ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। বন দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নয়াগ্রাম ব্লকে হাতির হানায় নষ্ট হওয়া ফসল ও সম্পত্তি এবং প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিবছর গড়ে ৩৫-৪০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত গড়ে দু’-তিন মাস নয়াগ্রামে থাকত হাতিরা। ছবিটা বদলায় গত বছর। গত বছর নয়াগ্রামে ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা কমে দাঁড়ায় ৯ লক্ষ। কোনও প্রাণহানিও হয় নি। কেন? কারণ গত বছর সব হিসেব উল্টে দিয়ে হাতিদের গতিপথে ‘পরিবর্তন’ হয়েছিল। গত বছর মাত্র কয়েকটা দিন কাটিয়ে হাতিরা নয়াগ্রাম ছেড়ে ওড়িশায় চলে যায়। ফলে ফসল ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই এড়ানো গিয়েছিল। তবে মাসখানেক ওড়িশায় কাটিয়ে ফের নয়াগ্রাম হয়েই হাতিরা ফিরে গিয়েছিল গত বছর। হাতিদের ওড়িশা যাওয়ার ব্যাখায় বন দফতর জানায়, নয়াগ্রামে ফসল বাঁচানোর জন্য গত কয়েক বছরে গ্রামবাসীর সম্মিলিত প্রতিরোধ বেড়েছে বহুগুণ। খাবারে টান পড়ালে আরও ভাল পরিবেশের খোঁজ পেলে হাতিরা নতুন এলাকায় যায়।
এ বারও হাতিরা ওড়িশার দিকে যাওয়ায় সাময়িক স্বস্তি পেয়েছেন নয়াগ্রামবাসী। তবে নির্দিষ্ট সময়ের ওড়িশার দিক থেকে হাতির পালকে নয়াগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এলাকাবাসীর পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, জোর করে হাতির পালের নিজস্ব গতিপথ বদলানোর চেষ্টা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। একই মত বন দফতরেরও। |