সঞ্চয় পরিকল্পনা |
বাজেট বানান আপনিও
অর্থমন্ত্রী বাজেট করেন। ঠিক করেন, দেশ চালাতে কোন খাতে কত টাকা
তুলে রাখবেন তিনি। তেমনই সংসার চালাতে আগাম পরিকল্পনা করুন
আপনিও।
ছকে রাখুন, বাড়ি, গাড়ি, বাচ্চার পড়াশোনার খরচ। তার পর
সঞ্চয়ের ঘুঁটি সাজান সেই অনুযায়ী। বলছেন অমিতাভ গুহ সরকার |
|
|
একটি দেশের মতো আর্থিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন প্রত্যেকটি পরিবারেরও। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বাহন ক্রয়, বিবাহ, ভ্রমণ, ঝুঁকির বিরুদ্ধে বিমা, পেনশন সব কিছুর জন্যই ব্যবস্থা রাখতে হবে এই পরিকল্পনায়। পরিকল্পনা এবং তার প্রয়োগ এমন হবে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনের সময়ে কোনও চাপ না-আসে। মাথায় রাখতে হবে করের ব্যাপারটিও। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য আপনার লগ্নি একটি জায়গায় রাখলে চলবে না। লগ্নি করতে হবে বিভিন্ন সম্পদ শ্রেণিতে (অ্যাসেট ক্লাস)। এতে প্রয়োজনের সময়ে উপযুক্ত টাকা হাতে আসবে। সেই সঙ্গে কমবে ঝুঁকিও।
যেমন ধরুন, আপনার বাড়ির কারও বিয়ের সময়ে যেন প্রয়োজনীয় সোনার সংস্থান থাকে। সন্তানের উচ্চশিক্ষার সময়ে যেন থোক টাকা হাতে আসে। অর্থাৎ বিয়ের কথা মাথায় রেখে অনেক আগে থেকে নিয়মিত লগ্নি করতে হবে সোনায়। সন্তানের শিক্ষার জন্যও তা করতে হবে রেকারিং ডিপোজিট অথবা মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি পদ্ধতিতে। নেওয়া যেতে পারে কোনও বিমা প্রকল্পও। এগুলি সবই আলাদা আলাদা সম্পদ শ্রেণি। আমাদের আজকের আলোচনা বিভিন্ন ধরনের সম্পদ শ্রেণি নিয়ে। আসুন এক এক করে তাদের উপর চোখ রাখি। |
ব্যাঙ্ক আমানত |
সুরক্ষার দিক থেকে অতি উত্তম। বিভিন্ন মেয়াদে টাকা রাখা যায় প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে। দরকারে আগে ভাঙানো সম্ভব। ভবিষ্যতে বিশেষ কোনও প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে খোলা যেতে পারে রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট। কর সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে টাকা রাখা যায় ৫ বছর মেয়াদি বিশেষ আমানত প্রকল্পে। ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত সুদ করযোগ্য। কিন্তু সেভিংস অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বার্ষিক সুদ করমুক্ত। |
ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্প |
শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা। সুদের দিক থেকেও এখন খারাপ নয়। মাসিক আয়ের জন্য আছে ডাকঘর মাসিক আয় প্রকল্প বা এমআইএস। কর সাশ্রয়ের জন্য এনএসসি। করের সুবিধা-সহ দীর্ঘ মেয়াদে তহবিল গড়ে তোলার জায়গা হল পিপিএফ। খোলা যায় রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্টও। পিপিএফ ছাড়া আর সব প্রকল্পের সুদ করযোগ্য। |
বন্ড এবং ডিবেঞ্চার |
নানা গুণ আছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ইস্যু করা বন্ডে। সুরক্ষা আছে। সুদের হারও মন্দ নয়। মূলধনী লাভ-কর সাশ্রয়ের জন্য আছে মূলধনী লাভ বন্ড। উঁচু হারের করদাতাদের জন্য আছে করমুক্ত বন্ড। শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ করা হয় এই ধরনের বন্ড। বন্ড কিনতে হবে রেটিং দেখে। সব থেকে সুরক্ষিত বন্ড পায় ‘ট্রিপল-এ’ রেটিং। ‘এএ+’ও মন্দ নয়। দেখেশুনে লগ্নি করতে হবে বেসরকারি সংস্থার বন্ডে। বন্ডের মতো ডিবেঞ্চারও এক ধরনের ঋণপত্র। উঁচু রেটিং এবং লিস্টিং করা না-হলে এড়িয়ে চলাই ভাল। |
কোম্পানি আমানত |
সুরক্ষার দিক থেকে একটু পিছিয়ে। খাতায়-কলমে সাধারণত জামিনবিহীন হয় কোম্পানি জমা প্রকল্প। অতীতে বহু মানুষ হাত পুড়িয়েছেন এই ক্ষেত্রে লগ্নি করে। বর্তমান আইন অবশ্য বেশ কঠোর। এ ছাড়া কিছু উচ্চ মানের কোম্পানি আছে, ভরসা করে যেখানে টাকা রাখা যায়। সর্বাধিক মেয়াদ ৩ বছর। সুদের হার সাধারণত ব্যাঙ্কের তুলনায় একটু বেশি হয়। তা অস্বাভাবিক বেশি হলে সন্দেহ করার কারণ থাকবে। সুদ পুরোপুরি করযোগ্য। কয়েকটি অগ্রণী গৃহঋণ কোম্পানির জন-আমানত প্রকল্প মন্দ নয়। একটু বেশি আয়ের জন্য অনেকে এদের প্রকল্পকে পছন্দ করেন। |
মিউচুয়াল ফান্ড |
যাঁদের লগ্নিযোগ্য অর্থ আছে, কিন্তু শেয়ার ও বন্ড বাজারে সরাসরি খাটানোর সময়, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নেই, তাঁরা কমবেশি ঝুঁকি নিয়ে লগ্নি করতে পারেন মিউচুয়াল ফান্ডে। ফান্ডের বিশেষজ্ঞরা আপনার টাকা আপনার পছন্দমতো লগ্নি করেন শেয়ার, বন্ড এবং মানি মার্কেটে। লাভের ভাগ আপনি পান। পাশাপাশি থাকতে পারে লোকসানের ভয়ও। এই সম্পদ শ্রেণিতে সাফল্য পেতে হলে লগ্নি করতে হয় একটু দীর্ঘ মেয়াদ অর্থাৎ ৩ বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য। নিচু বাজারে লগ্নি এবং উঁচু বাজারে বিক্রি করতে পারলে লাভ ঘরে আসে। এসআইপি পদ্ধতিতে নিয়মিত লগ্নি করলে ইউনিট কেনা যায় গড় দামে। তেজী বাজারে ন্যাভ গড় দামের উপরে উঠলেই লাভের মুখ দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে দীর্ঘ মেয়াদে বড় তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব। মনে রাখবেন, মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড পুরোপুরি করমুক্ত। |
ইক্যুইটি |
সব থেকে ঝুঁকির জায়গা, যা সব থেকে বেশি লাভও এনে দিতে পারে। ঝুঁকির প্রতি বহু মানুষের ঝোঁক থাকায় বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজার এত জনপ্রিয়। ঝুঁকি বাগে রেখে ইক্যুইটিতে লগ্নি করার কৌশল জানলে বড় দাঁও মারা যায় শেয়ার বাজারে। মন্দার বাজারে বাছাই করা প্রথম সারির শেয়ার কিনে রাখলে দীর্ঘ মেয়াদে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠতে পারে।
শেয়ার রাখার জন্য চাই একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট। শেয়ারের উপর প্রাপ্ত ডিভিডেন্ডের উপর কোনও কর দিতে হয় না। অনেকেই কিন্তু চড়া রিটার্নের সম্ভাবনার জন্য ইক্যুইটি শেয়ারকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ শ্রেণি হিসেবে গণ্য করেন।
প্রশ্ন হল, তহবিলের কতটা শেয়ারে লগ্নি করা উচিত হবে? এই ব্যাপারে একটি ফর্মুলা আছে। ৭৫ (গড় আয়ু) থেকে আপনার বর্তমান বয়স বাদ দিন। যা থাকবে, তহবিলের তত শতাংশ লগ্নি করা যেতে পারে ইক্যুইটিতে। যেমন আপনার বয়স যদি ৩৫ হয় তবে সর্বাধিক ৪০ শতাংশ। ৫০ হলে ২৫ শতাংশ। ৬০ বছর হলে ১৫ শতাংশ ইত্যাদি। অর্থাৎ কম বয়সে বেশি লগ্নি এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইক্যুইটিতে লগ্নি কমিয়ে আনলে ভাল হয়। সরাসরি শেয়ার না-কিনে ইক্যুইটি ফান্ডের মাধ্যমেও লগ্নি করা যায় শেয়ার বাজারে। |
সোনা |
অর্থনৈতিক দুর্যোগের দিনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সম্প্রতি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লগ্নির জায়গা হিসেবে। গত কয়েক বছরে শেয়ারের থেকেও বেশি লাভের সন্ধান দিয়েছে এই হলুদ ধাতু।
ভবিষ্যতে বিয়ে ইত্যাদি কারণে সোনার প্রয়োজন থাকলে, তা আগে থাকতে দীর্ঘ মেয়াদে জমানো যায়। গয়না অথবা স্বর্ণমুদ্রা কেনা যেতে পারে। অথবা যোগদান করা যেতে পারে স্বর্ণ সঞ্চয় প্রকল্পে। সোনায় যাঁরা লগ্নি করতে চান, তাঁরা কিনতে পারেন গোল্ড ইটিএফ। আবার এসআইপি পদ্ধতিতে লগ্নিও করতে পারেন মিউচুয়াল ফান্ডের গোল্ড ফান্ডে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বাজারে তহবিলের ১০ শতাংশ সোনায় লগ্নি করতে পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকেই। |
সম্পত্তি |
সন্তানের উচ্চশিক্ষা অথবা বিয়ে বাবদ বড় খরচের সমস্যা অনেকটা মেটানো যেতে পারে বছর দশেক আগে সম্ভাবনাময় অঞ্চল চিহ্নিত করে সেখানে জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি কিনে রেখে। খেয়াল রাখবেন, মালিকানায় যেন কোনও গলদ না-থাকে এবং বে-দখল হওয়ার ভয় না-থাকে। |
বিমা |
ঝুঁকির বিরুদ্ধে বড় দাওয়াই হল বিমা। সংসারে উপার্জনকারীর নামে উপযুক্ত অঙ্কের বিমা নেওয়া থাকলে, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর কিছু হলেও সংসার একেবারে ভেসে যায় না। কোনও বড় ঋণ থাকলে তার সমপরিমাণ বিমা থাকাও কিন্তু ভীষণ জরুরি। থাকতে হবে পরিবারের প্রত্যেকের নামে উপযুক্ত অঙ্কের স্বাস্থ্য বিমাও। সব রকম ঝুঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থাকলে, মানসিক শান্তি থাকে। হঠাৎ মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার ভয় থাকে না।
লগ্নি করার আগে যে বিষয়গুলি বিচার্য, তা হল লগ্নিযোগ্য তহবিলের আকার, ভবিষ্যতের প্রয়োজন অনুযায়ী লগ্নির মেয়াদ, আয়, করযোগ্যতা, প্রয়োজনে ভাঙানোর সুবিধা, সুরক্ষা, ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য ইত্যাদি। |
লেখক ম্যাকলিওড রাসেল ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|