|
|
|
|
|
|
মিউচুয়াল ফান্ড |
|
নিয়মিত আয় যেখানে পাকা
ঝুঁকি কম অথচ রিটার্ন ভাল। লগ্নি করতে যাঁরা এমন জায়গা খোঁজেন,
তাঁদের জন্য
ডেট ফান্ড
মন্দ ঠিকানা নয়।
বিশেষত বাজারের
বর্তমান
পরিস্থিতিতে। আসুন, এর
সুবিধা-অসুবিধাকে
দাঁড়িপাল্লায় তুলি আমরা। বলছেন নীলাঞ্জন দে |
|
এ পর্যন্ত আমরা ঘোরাফেরা করেছি শুধু ইক্যুইটি ফান্ডের চৌহদ্দির মধ্যে। কারণ বেশির ভাগ লগ্নিকারী এই ফান্ড নিয়েই মাতামাতি করেন। অথচ মিউচুয়াল ফান্ডের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি ডেট ফান্ডের কথা বলা না-হয়। বিনিয়োগের মাধ্যম হিসাবে এই ফান্ডের ভূমিকা অস্বীকার করার কিন্তু কোনও জায়গা নেই।
ডেট ফান্ড কী?
ডেট ফান্ড নাম থেকেই তহবিলের চরিত্র জলের মতো পরিষ্কার। এই ধরনের তহবিলের টাকা লগ্নি করা হয় বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রে (সিকিউরিটিজ)।
সুবিধা? লগ্নির টাকা থাকে তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত। কারণ সরকার-সহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণের সূত্র এই ঋণপত্র। নির্দিষ্ট সুদের হারে বাজার থেকে এই ঋণ তোলে সরকার বা সংস্থাগুলি। ফলে এই ধরনের তহবিল থেকে লগ্নিকারীর আয়ও (ইনকাম) বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুনিশ্চিত (ফিক্সড)। এই সমস্ত ‘ফিক্সড-ইনকাম সিকিউরিটিজ’-এর মধ্যে পড়ে বন্ড, ডিবেঞ্চার, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ (সংক্ষেপে গিল্টস) ইত্যাদি। ডেট ফান্ডের প্রধান লক্ষ্যই হল, লগ্নিকারীদের নিয়মিত ও স্থায়ী রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেওয়া।
|
সুবিধা কোথায়? |
এর আকর্ষণের আসল রহস্য কম ঝুঁকি, নিয়মিত ও স্থায়ী আয়। এমন কিছু ডেট ফান্ডও রয়েছে, যেগুলিকে মনে হতে পারে ‘চিরসবুজ’। অর্থাৎ তাদের আকর্ষণ কখনও, কোনও অবস্থাতেই ফিকে হয় না। বছরের পর বছর ভাল রোজগার দেয়। যে-কারণে লগ্নিকারীদের মধ্যে যাঁরা বেশ পাকা খেলোয়াড়, তাঁরা সব সময়েই বিনিয়োগের একটা অংশ ডেট ফান্ডে লাগিয়ে রাখেন। এ ছাড়া এর আর একটি বড় চমক, ভবিষ্যতে ফান্ড কতটা রিটার্ন দিতে পারে, সে সম্পর্কে আগে থেকেই আভাস পাওয়ার সুবিধা। দূরদর্শী লগ্নিকারীরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারেন, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কতটা তহবিল গড়তে পারবে তাঁর ফান্ড।
পাশাপাশি, ডেট ফান্ডে লগ্নি করার পদ্ধতি কিছুটা সহজ-সরল। বিনিয়োগ আসার পর তহবিল পরিচালনা করাও সহজ ফান্ড ম্যানেজারের পক্ষে।
এই সব গুণের জন্য বিভিন্ন লগ্নিকারী সংস্থার পছন্দের তালিকায় বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে ডেট ফান্ড। এমনকী খুচরো লগ্নিকারীদের ক্ষেত্রেও ফান্ডের এই গুণগুলিই তুরুপের তাস। |
|
ঝুঁকি কতটা? |
অন্য যে-কোনও মিউচুয়াল ফান্ডের মতো এতেও বিশেষ কয়েকটি ঝুঁকি এড়ানো মুশকিল। যেমন, ‘ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজে’ লগ্নি করা এই ফান্ডে প্রভাব ফেলে ঋ
ণপত্রের বাজারের (ডেট মার্কেট) ওঠা-পড়া। আর যে- সিকিউরিটিজে টাকা খাটানো হচ্ছে, তার চরিত্রের উপর নির্ভর করে ঝুঁকির পরিমাণ। তবে আগেই বলে রাখছি, ইক্যুইটি ফান্ডে ঝুঁকি আরও বেশি। কিন্তু রিটার্নের নিরিখে ইক্যুইটি ফান্ডের সঙ্গে কিন্তু ডেট ফান্ডের তুলনা টানবেন না। কারণ ইক্যুইটি ফান্ডে লগ্নি থেকে পাওয়া রিটার্ন বা তৈরি তহবিল অনেক গুণ বেশি।
এ বার ডেট ফান্ডের বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির মধ্যে দু’টিতে একটু বিশেষ ভাবে নজর দেব আমরা (১) ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক বা সুদের হার সংক্রান্ত ঝুঁকি: বাজারে সুদ বাড়লে হাতে থাকা ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটির দাম কমে। আবার সুদ কমলে ওই সিকিউরিটির দাম বেড়ে যায়। আর দাম কতটা উঠবে বা পড়বে, সেটা নির্ভর করে সিকিউরিটির সুদের হার (রেট) এবং তার মেয়াদের (ম্যাচিওরিটি) উপর। এই বিষয়টি ডেট ফান্ডের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
সহজ করে বলছি। ধরা যাক, ১০% সুদে (যা বাজারের বর্তমান সুদ) আজ একটা ১০০ টাকার (ফেস ভ্যালু) ঋণপত্র কিনলেন আপনি। এক বছর পরে ১১০ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে। এ বার পরের দিনই বাজারের সুদের হার দাঁড়াল ১৫%। অর্থাৎ এ বার বাজারে ১০০ টাকার কম বিনিয়োগ করলেই বছর শেষে ১১০ টাকা পাওয়া যাবে। আপনি কেনার পরের দিন ওই ঋণপত্র যদি ১০০ টাকায় বিক্রি করেন বছর শেষে ১১০ টাকা ফেরত পাওয়ার প্রতিশ্রুতি-সহ, তা হলে লোকে কিনবে কেন? এখন তো বাজারে ১০০ টাকার ঋণপত্র পাওয়া যাচ্ছে ১১৫ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে। ফলে আপনাকে হাতের ঋণপত্র বেচতে হবে কম দামে অর্থাৎ ডিসকাউন্টে। সে ক্ষেত্রে বছর শেষে ১১০ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে আপনার বন্ডের দাম হবে এখন প্রায় ৯৫.৬৫ টাকা। অর্থাৎ দেখুন, বাজারে সুদের হার বাড়ায় আপনার বন্ডের দাম পড়ল।
আবার বাজারে সুদ কমলে ঘটবে ঠিক এর উল্টোটা। বন্ডের দাম বাড়বে বলে আপনি তা বিক্রি করতে পারবেন প্রিমিয়ামে। মোদ্দা কথা, সুদের হার পড়লে স্বল্পমেয়াদে ডেট ফান্ডের ন্যাভ বাড়ে। সুদ বাড়লে স্বল্পমেয়াদে ফান্ডের ন্যাভ পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
(২) ক্রেডিট রিস্ক বা ঋণ সংক্রান্ত ঝুঁকি: ধরুন একটি সংস্থা বাজারে সিকিউরিটি ছাড়ল। এবং আপনি তা কিনলেন। এ বার আপনার আশঙ্কার জায়গাটা হল, আর্থিক সঙ্কট বা অন্য কোনও কারণে সংস্থাটি ওই সিকিউরিটিতে যে সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা দিল না। কিংবা সিকিউরিটির মেয়াদ শেষের পরে যে-মূলধন ফেরত পাওয়ার কথা ছিল, তা পেলেন না।
আবার কোনও কারণে সংস্থাটির ক্রেডিট রেটিং কমে গেলেও আপনি বিপাকে পড়তে পারেন। ক্রেডিট রেটিং হল, কোনও সংস্থাকে ঋণ দেওয়া কতটা ঝুঁকির, তার মূল্যায়ন। অর্থাৎ রেটিং যত ভাল, ঋণ দেওয়া তত কম ঝুঁকির। আর তা কমার মানে ঋণের অর্থ ফেরত না-পাওয়ার ঝুঁকি বাড়া। বিভিন্ন রেটিং সংস্থা এই মূল্যায়নের কাজ করে। সিকিউরিটি বিক্রেতা সংস্থার ক্রেডিট রেটিং কমলে আপনার সিকিউরিটির চাহিদা কমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। |
নিরাপদ থাকার পথ |
ডেট ফান্ডে লগ্নির উদ্দেশ্য কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে খেলা নয়। বরং একটা নিয়মিত স্থায়ী আয়ের সংস্থান করা। কাজেই সেটা মাথায় রাখুন। লগ্নির নিরাপত্তার খাতিরে সরকারের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিন। কারণ এতে ‘সভরেন সিকিউরিটি’ অর্থাৎ সরকারি গ্যারান্টি থাকে। লোকসান হলে পুষিয়ে দেওয়ার দায় নেয় সরকার। কর্পোরেট বন্ডে লগ্নি করলে অনেক ক্ষেত্রে বেশি মাথা ঘামাতে হয়। যার কারণ বেশি মাত্রায় ক্রেডিট রিস্ক। যেটা নিয়ে আগেই বলেছি।
আবার বিভিন্ন কর্পোরেট বন্ডেও নিরাপত্তার একাধিক স্তর থাকে। মূল্যায়ন সংস্থা যে-বন্ডকে বেশি রেটিং দিয়েছে, তাতে লগ্নি করুন। এড়িয়ে চলুন ওই একই রেটিং সংস্থার করা তুলনায় কম রেটিংয়ের বন্ডকে।
|
দীর্ঘমেয়াদে সুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না |
তবে একটা কথা, আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদের জন্য ডেট ফান্ডের লগ্নিকারী হন, তা হলে সুদ নিয়ে অত ভাববেন না। সুদ বদলাতেই থাকবে। আপনার তো লক্ষ্য একটা স্থায়ী, নিয়মিত রোজগারের পথ। সেটা থেকে বঞ্চিত হবেন না আপনি। |
টাকা ঢালবেন কখন? |
কী কী পরিস্থিতিতে আপনি ডেট ফান্ডে বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারেন, তা এ বার নীচে একটু সাজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি
• ইক্যুইটি ফান্ডে ঝুঁকি নিয়ে লগ্নি করতে করতে ক্লান্ত। এ বার একটু কম ঝুঁকিতে বিনিয়োগের পথে পা বাড়াতে চান।
•
স্থায়ী আমানতের নিশ্চিত রিটার্নই আপনার ভরসা। কিন্তু মেয়াদ শেষে হয়তো দেখবেন, যা পেলেন, সেই সময়ের মূল্যবৃদ্ধির হিসাবে তা অতি সামান্য।
•
নিয়মিত মোটামুটি ভাল রিটার্নেই খুশি আপনি।
• শুধু টাকার চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট করার ইচ্ছা নেই। এ নিয়ে অকারণ ঝক্কি-ঝামেলা পছন্দ নয় আপনার।
• হাতে একেবারে সময় নেই, বা অনেকটা সময়। অসংখ্য স্বল্পমেয়াদি ডেট ফান্ড রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান রয়েছে, যাদের সুদের হার নিয়ে ঝুঁকি কম। আবার দীর্ঘমেয়াদি ফান্ডও রয়েছে। এদের মধ্যে ইচ্ছে ও সুবিধা মতো ফান্ড বেছে নিয়ে তাতে স্বচ্ছন্দে লগ্নি করতে পারেন আপনি।
|
ফান্ড পছন্দের পূর্বশর্ত |
• নিজেকে প্রশ্ন করুন: ‘হাতে কতটা সময় আছে?’ অল্প কয়েক সপ্তাহ থাকলে লিকুইড ফান্ডই ভাল। ছোট-মাঝারি মেয়াদেরও বহু ফান্ড আছে। বেছে নিন কোনও একটা।
• যদি দু’চার বছর ধরে টাকা রাখতে চান, তা হলে এমন ডেট ফান্ড নিন যা কর্পোরেট বন্ড, গিল্টস ইত্যাদিতে মিলিয়ে মিশিয়ে লগ্নি করেছে। ফান্ড ম্যানেজার মাথা খাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের বন্ডে টাকা লাগাতে পারলে ভাল সুদ পাবেন।
• যে লগ্নিকারীদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত, তাঁরা বাড়তি
অর্থ লাগান স্বল্পমেয়াদি ডেট ফান্ডে। এই সব ফান্ডে সুদ থেকেও আয় হবে। আবার মেয়াদ শেষে মূলধন বৃদ্ধির ফলেও অর্থ আসবে।
• যে ফান্ড বাছবেন, সেটির পারফরম্যান্স সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানুন। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন সুদের হারে ফান্ডটি কেমন ফল করেছে। ফান্ড ম্যানেজার বিভিন্ন বন্ডে কী ভাবে সম্পদ বাঁটোয়ারা করেছেন। এবং তাঁর কৌশল আপনার ভাবনার সঙ্গে মিলছে কি না ইত্যাদি।
|
লেখক উইশলিস্ট ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজর্সের ডিরেক্টর
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|