রাজীব গাঁধী ইক্যুইটি সেভিংস স্কিম
প্রথম শেয়ার
দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শেষ বাজেটে বেশ সাড়া ফেলে দেওয়া একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। যার নাম রাজীব গাঁধী ইক্যুইটি সেভিংস স্কিম (আরজিইএসএস) বা রাজীব গাঁধী শেয়ার সঞ্চয় যোজনা। সেখানে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে আরও অনেক বেশি করে শেয়ার বাজারের উঠোনে টেনে আনতে করছাড়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন তিনি। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে পা বাড়ানোর পর এই প্রকল্প নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পের ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের জন্য বিবৃতিও জারি করেছে কেন্দ্র। আসুন, সেই কাগজখানা সামনে রেখে আজ বিষয়টি অল্প-বিস্তর বোঝার চেষ্টা করি আমরা।

করতে পারবেন কারা?
• শুধুমাত্র শেয়ার বাজারে আনকোরা নতুন লগ্নিকারীরা। যাঁরা আগে কখনও কোথাও এক পয়সারও শেয়ার বা ডেরিভেটিভ লেনদেন করেননি। কেনেননি মিউচুয়াল ফান্ড-ও। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি যাচাই করা হবে প্যান নম্বরের ভিত্তিতে।
• আগে থেকে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলা থাকলে ক্ষতি নেই। কিন্তু মনে রাখবেন, বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার (নোটিফিকেশন) দিন পর্যন্ত সেখানে এক টাকারও কেনা-বেচা হলে, আর এই প্রকল্পে সামিল হতে পারবেন না আপনি। স্বাভাবিক ভাবেই পাবেন না করছাড়ের সুযোগও। এ নিয়ে ব্রোকারের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না।
• বছরে আয় হতে হবে ১০ লক্ষ টাকা কিংবা তার কম।

লগ্নির লক্ষ্মণরেখা
•প্রকল্পের সুবিধা সারা জীবনে এক বারই। প্রতি বছর নয়। কারণ, এক বার শেয়ার কিনে ফেললেই তো আপনি আর বাজারে নতুন নন।
• এই যোজনায় সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনতে পারবেন আপনি। অবশ্যই তার থেকে বেশি টাকার শেয়ার কিনতে পারেন। কিন্তু করছাড়ের সুবিধা তাতে পাবেন না।

সুবিধা কোথায়?
• আয়কর আইনের ৮০-সিসিজি ধারায় করছাড়।
• মোট যত টাকার শেয়ার কিনবেন, করছাড় মিলবে তার অর্ধেক অঙ্কের (৫০%) উপর। অর্থাৎ, কেউ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনলে, করের আওতা থেকে বাদ যাবে ২৫ হাজার টাকা। সুতরাং এই প্রকল্পে লগ্নি করে সব থেকে বেশি ৫ হাজার টাকা (৫০ হাজারের শেয়ার এবং ২০% করের হার ধরলে) বাঁচাতে পারবেন আপনি।

করবেন কী ভাবে?
• প্রথমেই ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলুন। আপনার ইচ্ছে মতো তা খুলতে পারেন কোনও ব্যাঙ্ক কিংবা ব্রোকারেজ সংস্থার কাছে। বাজার নিয়ন্ত্রক সেবির পাঠানো সার্কুলার অনুযায়ী, এই প্রকল্পের জন্য ওই অ্যাকাউন্ট খুলতে কোনও খরচ করতে হবে না। নিখরচায় তা খুলে দেবে ব্যাঙ্ক কিংবা ব্রোকারেজ সংস্থাই। এমনকী এক পয়সাও খরচ না-করে ওই ‘নো-ফ্রিলস্’ (সাধারণ) অ্যাকাউন্ট ‘মেনটেন’-ও করতে পারবেন আপনি।
মনে রাখবেন, যৌথ ভাবেও ওই অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। কিংবা করা যাবে নমিনি। সত্যি বলতে কী, যৌথ ভাবে কিংবা নমিনি-র নাম উল্লেখ করেই তা খোলা বাঞ্ছনীয়। যদি আপনি কারও সঙ্গে (ধরা যাক, স্ত্রী) যৌথ ভাবে এই অ্যাকাউন্ট খোলেন, এবং সেখানে প্রথম নাম আপনার হয়, তা হলে সেখানকার শেয়ারের মালিক আপনি। করছাড়ের সুবিধাও আপনার। স্ত্রীয়ের জন্যও এই একই সুবিধা পেতে ফের একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন আপনারা। তবে সেখানে প্রথম নাম হতে হবে আপনার স্ত্রীয়েরই।
• এর পর ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে ব্রোকারেজ সংস্থার কাছে। এর জন্য জমা দিতে হবে ‘কেওয়াইসি’ (সচিত্র পরিচয়পত্র, ঠিকানার প্রমাণ ইত্যাদি)। তবে সেখানে কিন্তু টাকা দিতে হতে পারে আপনাকে। কারণ, বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
• এ বার কিনে ফেলতে পারেন ৫০ হাজার টাকার পর্যন্ত শেয়ার। তবে করছাড়ের সুযোগ পেতে কিনতে হবে শুধু এই প্রকল্পের জন্য স্বীকৃত (আরজিইএসএস কোয়ালিফায়েড) শেয়ারই। অর্থাৎ, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের সিএনএক্স-১০০ এবং বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের বিএসই-১০০ এই দুই সূচক যে-সমস্ত সংস্থার শেয়ার ‘নিয়ে তৈরি’, কেনা যাবে শুধু তাদের শেয়ারই। টাকা ঢালা যাবে বাছাই করা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড কিংবা এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডেও (ইটিএফ)। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তাদের এই প্রকল্পের জন্য স্বীকৃত হতে হবে।
• লগ্নির সময়ে পুরো টাকা যে একবারে দিতে হবে, এমনটা একেবারেই নয়। তা দিতে পারেন নিজের সুবিধামাফিক কিস্তিতেও। কিন্তু তা দিতে হবে অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার আগেই। অর্থাৎ ৩১ মার্চের মধ্যে।

বিধির বাঁধন
করছাড়ের সুবিধা পেতে কিন্তু দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে আপনাকে—
(১) যে-শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কিনবেন, এক বছর তা কোনও ভাবেই বিক্রি করতে পারবেন না।
(২) তার পর মুনাফা ঘরে তুলতে শেয়ার বিক্রি করতে পারেন ঠিকই। কিন্তু যত টাকার বিক্রি করবেন, তত টাকার শেয়ার কিন্তু ফের কিনতে হবে আপনাকে। এবং তা ধরে রাখতে হবে আরও দু’বছর (মোট তিন বছর)।
একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি একটু খোলসা হতে পারে। ধরুন, আগামী ১ ডিসেম্বর ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনলেন আপনি। তা হলে পরের বছরের ওই তারিখ পর্যন্ত তা কোনও মতেই বিক্রি করা চলবে না। মনে করা যাক, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মুনাফা ঘরে তুলতে এর মধ্যে ২০ হাজার টাকার শেয়ার বেচে দিলেন আপনি। সে ক্ষেত্রে ফের ২০ হাজার টাকার শেয়ার কিনতে হবে আপনাকে। এবং তা ধরে রাখতে হবে আরও দু’বছর। ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। করছাড়ের সুবিধা পেতে এই ‘লক-ইন পিরিয়ড’ মানতেই হবে আপনাকে।

সংশয় কোথায়?
এই প্রকল্প ঘোষণার পিছনে সরকারের যে উদ্দেশ্য ছিল, তার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সরকার চেয়েছিল, শুধু ব্যাঙ্ক কিংবা ডাকঘরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ শেয়ার বাজারে আসুক। বাড়ুক সাধারণ ছোট লগ্নিকারীর সংখ্যা। কিন্তু বিবৃতি পড়ে মনে হল, এই লক্ষ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে বিস্তর। শুধুমাত্র এক বার করছাড়ের সুযোগ দিয়ে মানুষকে কতটা শেয়ার বাজারে টেনে আনা যাবে, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। তা ছাড়া, বিবৃতির অনেক অংশই এখনও ভীষণ রকম অস্পষ্ট। ফলে, সেই জায়গাগুলি পরিষ্কার না-হলে, লগ্নি করা থেকে পিছিয়ে যাবেন সাধারণ মানুষ।
আমার মনে হয়, এই প্রকল্প জনপ্রিয় করতে হলে, অন্তত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হবে সরকারকে। যেমন—
(১) মাত্র ৫০ হাজার টাকা বা তারও কম অঙ্কের কেনা-বেচা করে ব্রোকারের লাভ হবে কতটুকু? তাই তার মধ্যে নিখরচায় ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার দায় বয়ে সে খুচরো লগ্নিকারী খোঁজার খরচ বইতে চাইবে কেন?
(২) প্রথম শেয়ার কেনা, সেই শেয়ারের মূল্যায়ন (ভ্যালুয়েশন), এক ও তিন বছরের ‘লক-ইন পিরিয়ড’ ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে নজরদারি (মনিটরিং) করবে কে? কে মিলিয়ে নেবে এক বার বিক্রির পর সমান টাকার শেয়ার ফের কেনা হল কি না। এ বিষয়ে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সেবির মনোভাব এখনও স্পষ্ট নয়। এই দায়ও ব্রোকারেজ সংস্থার উপর চাপলে, তার জন্য বইতে হবে মোটা খরচ। কঠিন হবে মুনাফার মুখ দেখা। সংস্থাগুলি তা হলে এই প্রকল্পে উৎসাহী হবে কেন?
(৩) সারা জীবনে এক বার মাত্র ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কেনার উপর করছাড় দিয়ে, সাধারণ মানুষকে সত্যিই কি টেনে আনা যাবে বাজারের চৌহদ্দিতে? করছাড় না-থাকলে তা হলে দ্বিতীয় বার আর কেন শেয়ার কিনবেন তাঁরা?
প্রকল্পকে সাফল্যের মুখ দেখাতে আগে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সরকারকে। নইলে তার ‘জনপ্রিয় তারকা’ হওয়ার আশা না-করাই ভাল।

নজর রাখুন বিজ্ঞপ্তির দিকে
এই যোজনা নিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সংবাদ মাধ্যমের জন্য লিখিত বিবৃতি জারি করেছিল কেন্দ্র। আজকের পুরো আলোচনাই তার ভিত্তিতে করা। কারণ, লেখার দিন পর্যন্ত এ নিয়ে মূল সরকারি বিজ্ঞপ্তি বেরোয়নি। সেখানে কোনও কিছু বদলে গেলে কিন্তু প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে হতে পারে আমাদের।

অজিতবাবু ডেকো সিকিউরিটিজের ডিরেক্টর এবং শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.