নিখরচায় চিকিৎসা
গের সংখ্যায় চিকিৎসা বিমার গোড়ার বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমরা। এর সুবিধা থেকে শুরু করে রকমফের কথা হয়েছে অনেক প্রসঙ্গেই। জানানো হয়েছে, এই বিমা কেনার সময়ে কী কী মাথায় রাখতে হবে। এ বারের আলোচনায় ঠিক এর পরের ধাপ নিয়ে কথা বলব আমরা। জানতে চেষ্টা করব, প্রয়োজনের সময়ে কী ভাবে বিমা সংস্থার কাছ থেকে চিকিৎসার খরচ আদায় করতে পারবেন আপনি। সেই সূত্রেই বার বার উঠে আসবে ক্যাশলেস পরিষেবার বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করব, কী ভাবে এর মাধ্যমে নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে আপনার। সেখানে টিপিএ-র ভূমিকা কী? জানব, কোনও বিমা সংস্থা এই পরিষেবা সরাসরি দিতে পারে কি না।

নিশ্চিন্তির দুই পথ
বিমার সুরক্ষা বুক পকেটে থাকলে, চিকিৎসা খরচের দায় দু’ভাবে নিতে পারে সংস্থা—
(১) ক্যাশলেস ব্যবস্থা: এখানে গাঁটের কড়ি খরচ না-করেই চিকিৎসা করানোর সুযোগ পেতে পারেন বিমাকারী। সে ক্ষেত্রে সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া থাকা হাসপাতালেই ভর্তি হতে হবে তাঁকে। এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা জানাতে হবে ভর্তি হওয়ার সময়েই (প্ল্যানড্ হসপিটালাইজেশনের বেলায় আরও আগে)। তা হলে সেরে ওঠার পর হাসপাতাল ছাড়ার আগে বিল মিটিয়ে দেবে বিমা সংস্থাই। মোট খরচ ‘কভারেজ’ বা ‘সাম ইনসিওর্ড’-এর কম বা সমান হলে, পকেট থেকে কোনও টাকা খরচ করতে হবে না আপনাকে।
(২) রিইম্বার্সমেন্ট বেনিফিট: এই ব্যবস্থায় কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন খরচ মেটাতে হবে আপনাকেই। সামলে রাখতে হবে যাবতীয় বিলের রসিদ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি। পরে তা দেখে সেই খরচ মিটিয়ে দেবে বিমা সংস্থা।

সুবিধা কোথায়?
এই দু’য়ের মধ্যে ক্যাশলেস ব্যবস্থাই যে বেশি সুবিধাজনক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা করানোর সময়ে টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতে হচ্ছে না আপনাকে। বাড়ি থেকে বার করতে হচ্ছে না নগদ টাকাও। শুধু তা পেতে হয়তো তুলনায় সামান্য বেশি প্রিমিয়াম গুনতে হচ্ছে। গ্রাহকদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে এই পরিষেবা চালু করতে গিয়েই প্রথম ‘থার্ড পার্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ বা ‘টিপিএ’ ব্যবস্থার উৎপত্তি।


টিপিএ কী?
সাধারণত গ্রাহকদের ক্যাশলেস পরিষেবা দিতে তৃতীয় একটি সংস্থাকে নিয়োগ করে কোনও বিমা সংস্থা। তারই নাম থার্ড পার্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা টিপিএ। সাধারণ বিমা সংস্থার হয়ে চিকিৎসা বিমা পরিষেবা পরিচালনা করে এই সংস্থাগুলি। ২০০৩ সালে এই ব্যবস্থায় অনুমোদন দেয় বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ।
বিভিন্ন হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের সঙ্গে চুক্তি করে টিপিএ। যাতে সেখানে চিকিৎসা করানোর সময়ে ক্যাশলেস পরিষেবা পেতে পারেন গ্রাহক।
তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, এখন কিন্তু টিপিএ ব্যবস্থার বাইরেও (সরাসরি) ক্যাশলেস পরিষেবা চালু করেছে কোনও কোনও চিকিৎসা বিমা সংস্থা। আগামী দিনে এই পদ্ধতি আরও জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা।

চিকিৎসা বিমা মানেই কি টিপিএ?
না। একেবারেই নয়। যে সব বিমা সংস্থা টিপিএ-র মাধ্যমে ক্যাশলেস পরিষেবা দেয়, তাদের থেকে পলিসি কিনলে ওই ব্যবস্থার মধ্যে থাকতেই হবে আপনাকে। কিন্তু ক্যাশলেসের সুবিধা না-চাইলে, টিপিএ ব্যবস্থায় থাকার প্রয়োজনই নেই। সে ক্ষেত্রে তাদের এড়িয়ে সরাসরি বিমা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন আপনি।
তা ছাড়া, বিমা করতে পারেন এমন কোনও সংস্থায়, যারা সরাসরি ক্যাশলেস পরিষেবা দেবে আপনাকে।
ক্যাশলেস পলিসি কিনলে, নিখরচায় (নথিভুক্ত) হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন আপনি। চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে দেবে বিমা সংস্থাই। কিন্তু এই ধরনের প্রকল্পে সাধারণত প্রিমিয়ামের অঙ্ক হয় ৬ শতাংশ মতো বেশি।

অভিযোগও কিন্তু অনেক
টিপিএ ব্যবস্থা চালু করার পিছনে মূল লক্ষ্য ছিল গ্রাহককে দ্রুত ও উন্নততর পরিষেবা দেওয়া। কিন্তু গত ন’বছরে এই ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগও উঠেছে বিস্তর। যেমন—
•ক্যাশলেস পরিষেবার আওতায় থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় চিকিৎসার পুরো খরচ দিতে অস্বীকার।
• আগাম প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিমার প্রাপ্য টাকা পেতে অযথা হয়রানি।
• হাসপাতালের দেওয়া চিকিৎসা বিল মানতে টিপিএ-র আপত্তি।
•তালিকায় থাকা হাসপাতালেও রোগীকে নিখরচায় ভর্তি করার ক্ষেত্রে হাজারো টালবাহানা ইত্যাদি।

প্রাপ্য আদায়ের শর্ত কিন্তু সঠিক ‘ক্লেম’
গ্রাহকদের যেমন টিপিএ নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে, তেমনই বিমা সংস্থাগুলিও মনে করে অনেক ক্ষেত্রে টাকা না-পাওয়ার কারণ কিন্তু ‘ক্লেম’-এর পদ্ধতি ঠিক না-থাকা। বহু ক্ষেত্রে যেমন গ্রাহক জানেনই না হাসপাতালে কোন ধরনের বেড বা কী দামের পরিষেবা তাঁর প্রাপ্য। পলিসির খুদে হরফের লেখা মন দিয়ে না-পড়ায় নিজের পকেট থেকেই টাকা দিতে হয় গ্রাহককে।

সুতরাং মনে রাখুন
সমস্যা এড়াতে প্রথমেই পলিসির যাবতীয় শর্ত খুঁটিয়ে পড়ুন। অবশ্যই মাথায় রাখুন অন্তত নীচের বিষয়গুলি—
• যে রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তা আপনার বিমার আওতায় আদৌ আছে কি না।
• হাসপাতালে কী ধরনের ঘর বা পরিষেবা আপনার প্রাপ্য। অর্থাৎ, রুম-রেন্ট, ডাক্তারের ফি ইত্যাদির ঊর্ধ্বসীমা কত। যেখানে ক্যাশলেস চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন, তা বিমা সংস্থার তালিকায় আছে তো?
• ক্যাশলেস পরিষেবা পেতে ভর্তির সময়ে অবশ্যই সঙ্গে রাখুন সংস্থা/ টিপিএ-র দেওয়া সচিত্র পরিচয়পত্র। নইলে কিন্তু ওই পরিষেবা কোনও ভাবেই পাবেন না আপনি।
• ভর্তির আগে ও পরে কত দিন চিকিৎসার খরচ পেতে পারেন।
• ‘কো-পে’ বা খরচের একটা অংশ বিমাকারীকে বইতে হবে, এমন কোনও শর্ত রয়েছে কি না।
• দুর্ঘটনার মতো আপৎকালীন ক্ষেত্রে (এমার্জেন্সি) হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা বিমা সংস্থা/ টিপিএ-কে জানান। পারলে সেই জানানোর প্রমাণ হাতে রাখুন।
• রিইম্বার্সমেন্টের ক্ষেত্রে প্রাপ্য টাকা হাতে পেতে হাসপাতাল ছাড়ার ৩০ দিনের মধ্যে চিকিৎসার সমস্ত নথি-সহ ক্লেম জমা দিন। বাড়ি আসার পরও (পোস্ট হসপিটালাইজেশন) চিকিৎসার খরচ বিমার আওতায় থাকলে, তা জমা দিন সেই চিকিৎসা শেষের ৩০ দিনের মধ্যে। অবশ্য এর থেকেও কম সময়ে ক্লেম জমা দিতে বলে কিছু কিছু সংস্থা। আগে থেকেই সেই সময়সীমা জানুন।
• সাধারণত হাসপাতালে ভর্তির কথা জানার পরই একটা ফর্ম দেয় বিমা সংস্থা বা টিপিএ। সঙ্গে বলে দেয়, জমা দিতে হবে এমন নথির তালিকা। সাধারণত জমা দিতে হয় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, রোগ নির্ণয় সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট এবং ওষুধ ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সব সরঞ্জামের ক্যাশ মেমো। জেনে নিন, এর বাইরেও কিছু লাগবে কি না।
• ডাক্তারের ফি শুধুমাত্র হাসপাতালের মাধ্যমেই দিতে হবে, এমন কোনও শর্ত নেই তো? সে ক্ষেত্রে কিন্তু অন্য ভাবে দিলে, পুরো ফি না-ও মেটাতে পারে বিমা সংস্থা।
• আপৎকালীন নয়, এমন চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে আগে থেকে ডাক্তারের সুপারিশ অবশ্যই প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা টিপিএ-র সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার খরচ অনুমোদন আগেভাগেই করিয়ে নিন। এই ‘প্রিঅথরাইজেশন’ কিন্তু জরুরি।

টিপিএ নিয়ে অভিযোগ থাকলে?
টিপিএ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে, সমাধানের খোঁজ করতে পারেন তিনটি উপায়ে—
(১) সরাসরি মূল বিমা সংস্থার কাছে অভিযোগ জানান।
(২) ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হোন।
(৩) সরাসরি বিমা সংস্থার কাছে অভিযোগ জানিয়েও ফল না-হলে, কড়া নাড়তে পারেন বিমা ওম্বাডসম্যানের দরজায়। তবে তারা কিন্তু ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থার বিরুদ্ধে। টিপিএ-র বিরুদ্ধে নয়।

টপ আপ-এর টিপস্
ধরুন, কোনও বিমা সংস্থা থেকে ৪ লক্ষ টাকার পলিসি কিনেছেন। এ বার অন্য আর একটি সংস্থা থেকে টপ-আপ পলিসি করাতে পারেন আপনি। সে ক্ষেত্রে প্রথম পলিসির ৪ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেলে, টপ আপ পলিসি থেকে কভারেজ পেতে পারবেন। তবে এই সুবিধা পাওয়া যাবে শুধুমাত্র একই রোগের টানা চিকিৎসার জন্য। সাধারণ চিকিৎসা বিমা প্রকল্পের প্রিমিয়ামের চার ভাগের এক ভাগ দাম দিয়েই টপ-আপ পলিসি কেনা যায় বলে এর এত কদর।
বোনাস বনাম লোডিং
একটি নির্দিষ্ট বছরে ক্লেম না-করলে, পরের বার পুনর্নবীকরণের সময়ে প্রিমিয়াম কম নেয় অনেক সংস্থা। কেউ আবার বোনাস হিসেবে বাড়িয়ে দেয় বিমাকৃত অর্থের পরিমাণ বা ‘সাম ইনসিওর্ড’-এর অঙ্ক। সাধারণত এই পরিমাণ বাড়ে বছরে ৫ শতাংশ করে। অর্থাৎ, কেউ এক লক্ষ টাকার পলিসি কেনার পর এক বছর ক্লেম না-করলে, পরের বছর বোনাস হিসেবে বাড়তি কভারেজ পাবেন ৫ হাজার টাকা। তেমনই আবার ক্লেম করলে, অনেক সময়ে পরের প্রিমিয়ামের অঙ্ক হয় বেশি। অনেক ক্ষেত্রে তা বাড়তে পারে ২০০-৩০০ শতাংশ পর্যন্ত। এরই নাম লোডিং।

অভিযোগ জানানোর ঠিকানা:
অফিস অফ দ্য ইনশিওরেন্স ওম্বাডসম্যান, কলকাতা
হিন্দুস্তান বিল্ডিং অ্যানেক্স
৪, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, চতুর্থ তল
কলকাতা- ৭০০০৭২


ফোন নম্বর: (০৩৩) ২২১২-৪৩৪০
ফ্যাক্স: (০৩৩) ২২১২-৪৩৪১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.