এ রকম গুহা আগে বোধহয় দেখেননি। ভবিষ্যতেও দেখার সুযোগ হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু পুজো মণ্ডপে ঢুকলে মনে হবে, সমুদ্রের নীচে কোনও গুহায় পৌঁছে গিয়েছেন আপনি। বাইরের কোনও শিল্পী নয়, দাঁইহাটের প্রীতম ক্লাবের সদস্যেরা নিজেরাই কুড়ি দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় রাসে গড়ে তুলেছেন এমন এক মণ্ডপ যেখানে দেখা মিলছে সামুদ্রিক কাঁকড়া থেকে কচ্ছপের।
রাস উৎসবে এ ভাবেই নিজেদের মেলে ধরেছে দাঁইহাটের ক্লাবটি। সদস্যেরা জানান, পরিবেশ বিধি মেনে চল্লিশ মাইক্রনের প্লাস্টিক প্যাকেট ব্যহার করা হয়েছে। ছোট ছোট প্যাকেটে জল ভরে তৈরি করা হয়ে গুহাটি। সব মিলিয়ে ২৫ হাজার প্যাকেট রয়েছে। ওই সব প্যাকেটের গা বেয়েই নেম আসছে বারিধারা। সমুদ্রের তলায় থাকছে সামুদ্রিক গাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ। মণ্ডপ তৈরির পরিকল্পনা ক্লাবের সদস্য, ব্যবসায়ী অলোক দাসের। তিনি বলেন, “প্রতি বছর আমাদের মণ্ডপসজ্জায় নতুনত্ব থাকে। এ বছর আমরা সামুদ্রিক প্রাণী বাঁচানোর বার্তা দিতেই এই মণ্ডপ বানিয়েছি।”
এ বছর দাঁইহাটে ৬২টি পুজো কমিটি রাস উৎসবে যোগ দিয়েছে। যাদের মধ্যে ৫২টি পুজো কমিটি আজ, বৃহস্পতিবার বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যোগ দেবে। শোভাযাত্রাটি শহরের সুভাষ রোড, চামপচা রোড ও বাজার, সব মিলিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা পরিক্রমা করবে। |
শোভাযাত্রা সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করতে কাটোয়া মহকুমা প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে দাঁইহাট রাস উৎসব কমিটি। এই কমিটির সহ-সভাপতি সন্দীপ দাসের দাবি, “বিভিন্ন পুজো কমিটির হয়ে অনুমতি নেওয়া থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আমরা কাটোয়া মহকুমা প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করে থাকি।” পুলিশ জানিয়েছে, দাঁইহাটের রাস সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে যথেষ্ট পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুরসভার তরফে শহরের পাঁচটি জায়গায় জলের ও ছ’টি জায়গায় স্বাস্থ্যশিবির খোলা হবে বলে রাস উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দাঁইহাটে শাক্ত দেবদেবীর আরাধনার চল ছিল। নবদ্বীপ থেকে শ্রীচৈতন্য দীক্ষা নেওয়ার জন্য দাঁইহাটের উপর দিয়েই কাটোয়ায় যান। কেশবভারতীর কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ার পরে দাঁইহাটের উপর দিয়েই নবদ্বীপে ফিরে যান। সেই সময়ে শাক্ত মতাবলম্বীদের অনেকেই বৈষ্ণব মতের অনুগামী হয়ে যান। মূলত তাঁদের উৎসাহেই নবদ্বীপের মতো দাঁইহাটেও রাস শুরু হয়। প্রথমে কোনও মূতি নয়, পটচিত্রেই বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো হত। বিসর্জনের দিন নৌকা করে পটগুলিকে ঘাগীরথীতে ঘোরানো হত। সেই কারণে দাঁইহাটে রাস উৎসব এক সময়ে ‘পট পূর্ণিমা উৎসব’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে শাক্ত মতাবলম্বীরাও রাস উৎসবে জড়িয়ে পড়েন। এখন শবশিবপাড়ায় কালীপুজোর মধ্যে দিয়েই দাঁইহাটে শুরু হয় রাস উৎসব। |
বিবেকানন্দ ক্লাবের মণ্ডপ। |
এ বছর কাটোয়া-কালনা (পুরনো) রোডে বিবেকানন্দ ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে রাজস্থানের একটি রাজ পরিবারের মূল গেটের আদলে। রয়েছে চন্দননগরের আলোর রোশনাই। তাদের পুজোর থিম ‘রাই রাজা’। এখানে রাধার মানভঞ্জন করছেন শ্রীকৃষ্ণ। ২৫১ বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। কাছেই বৌদ্ধ সঙ্ঘ ‘হেরিটেজ’ রক্ষার আবেদন জানাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের মতে, তাজমহল, আগ্রা কোর্ট, হাজারদুয়ারী-সহ ভারতের ঐতিহ্যকে রক্ষা করা উচিত। এর জন্য সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাঁরা আগ্রা কোর্টের গায়ে থাকা একটি মূর্তির অবক্ষয় চেহারা তাদের মণ্ডপে তুলে ধরছেন।
বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বিশেষ আকর্ষণ চন্দননগরের ‘ফোর-ডি’ আলো। সঙ্গে থাকবে শিশু ও বড়দের জন্য বিভিন্ন ধরনের মডেল। স্থানীয় বাসিন্দা সুরজ অগ্রবাল বলেন, “একটা উৎসব ঘিরে গোটা শহরের মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নামে, ভাবা যায় না।”
|
দাঁইহাটে বুধবার ছবি দু’টি তুলেছেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। |