|
|
|
|
সেই স্পিন রথচক্রের মেদিনী গ্রাস |
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • মুম্বই |
যা ছিল অতীতে অলঙ্কার। আজ তা কলঙ্ক।
যে দেশ আবহমান কাল ধরে সৃষ্টি করেছে একের পর এক কিংবদন্তি স্পিনার, উঠে এসেছেন বেদী-প্রসন্ন-চন্দ্রশেখরের মতো স্পিন-মহীরুহ, জন্ম দিয়েছে কোনও এক অনিল কুম্বলের, সেই একই দেশের ভূমিপুত্র এঁরাও। রবিচন্দ্রন অশ্বিন, হরভজন সিংহ এবং প্রজ্ঞান ওঝা। দেশের মাঠে বেদী-চন্দ্রশেখরদের পুরোদস্তুর ‘র্যাঙ্ক টার্নার’ লাগত না। ব্যাটিং উইকেট, সঙ্গে একটু স্পিন, তাতেই চলত। কিন্তু অশ্বিনদের লাগে। তবু লাভ হয় না। পছন্দের প্রশ্নপত্র পেয়েও ম্যাচ হারতে হয় সওয়া তিন দিনে। হারতে হয় দশ উইকেটে। ইংরেজদের স্পিন খেলার আঠাশ বছরের ‘দুর্নাম’-কে রাতারাতি সুনামে বদলে দিয়ে।
খুব সহজে, সেই স্পিন রথচক্রের আজ মেদিনীগ্রাস। ভারতীয় স্পিনের রথের চাকা এ বার সত্যি মাটি ছুঁল।
গ্রহণের নমুনা চাই? পরিসংখ্যান নির্বোধ হতে পারে, কিন্তু সব সময় ভুল বলে না। ওয়াংখেড়েতে রবিচন্দ্রন অশ্বিন দু’ইনিংস মিলিয়ে দিলেন মোট ১৬৭ রান। উইকেট মাত্র দু’টো। হরভজনের স্পিনেও আর সিংহ-গর্জন শোনা যায় না। ৮৪ রান দিয়ে দু’টেতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ওঝা শুধু মন্দের ভাল। ১৫৯ রানে পাঁচ। কিন্তু তিনিও মন্টি পানেসর নন। তাঁর স্পিনে সেই গতি নেই, যা সামলাতে মুখ থুবড়ে পড়বে ব্যাটসম্যান। ওয়াংখেড়েতে মন্টির মোট ১১-টা হল। যে ম্যাচে অশ্বিনদের মাথা হেঁট, সেই একই ম্যাচে ব্রিটিশ শিখ ঢুকে পড়লেন ওয়াংখেড়েতে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায়। মন্টি তিনে। ইয়ান বোথাম, লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণনের পরেই। লজ্জা নয়? |
|
মোতেরার উল্টে যাওয়া ছবি। সোমবার ওয়াংখেড়েতে। ছবি: উৎপল সরকার |
লজ্জার দৃশ্য আরও আছে। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা। হাতে একটা স্টাম্প তুলে প্রবল আক্রোশে ঝাঁকাতে শুরু করলেন নিক কম্পটন! সঙ্গে মুহুর্মুহু গর্জন। এমন পাশবিক উল্লাস স্বাভাবিক। যে বধ্যভূমি ইংরেজদের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে ভারতকেই কবরে পাঠানো গিয়েছে। ব্যাটিং। স্পিন বোলিং। দু’টোতেই। শুধু তাই নয়, ওঝা-অশ্বিনদের এত দিন ‘ব্রেকফাস্ট’ শুরু হত ডেনিস কম্পটনের নাতিকে দিয়ে। এ দিন ওই সামান্য ৫৭ রান তুলতে নেমে ওঝাদের তিনিও এমন মারলেন যে, ইডেনে ভারতীয় স্পিনারদের মানসিক স্থিতি ফেরাতে না এ বার সত্যি সত্যি ওঝার ঝাড়ফুঁকের দরকার পড়ে!
২০০৪-এর ওয়াংখেড়েকে ফেরানো এ দিন সম্ভব ছিল না। ৫৭ রানের টার্গেট দিয়ে ও সব হয় না। ভারত ১৪২ রানে শেষ হয়ে যাওয়ার পর ইংল্যান্ড রানটা তুলল দশ ওভারেরও কম সময়ে। মুম্বই আসার সময় ইংল্যান্ডকে ঘিরে প্রশ্নটা ছিল, ব্রাউনওয়াশ কি বাঁচাতে পারবে কুকের দল? আর এ বার তারা ইডেনে ঢুকছে গর্বের কলার তুলে। সিরিজ ১-১ করে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে। ‘নাউ ইটস লেভেল।’ ধোনির ব্রাউনওয়াশের স্বপ্ন খতম!
ম্যাচ শেষে স্পিনারদের একহাত নিয়ে রাখলেন ভারত অধিনায়ক। অসন্তুষ্ট ধোনি বলছিলেন, “সত্যি বলতে আমি প্রবল হতাশ আমার স্পিনারদের পারফরম্যান্স নিয়ে। মন্টি যেটা করে দেখিয়েছে সেটা আমাদের স্পিনাররা পারেনি। ব্যাকফুটে গিয়ে ওরা দিব্যি স্পিন ম্যানেজ করে দিয়েছে। উচিত ছিল, ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের সামনে টেনে আনা। মন্টির কাছেই আমরা শেষ হয়ে গেলাম।” ভারত অধিনায়কের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। যে কীর্তি ক্যাপ্টেন হিসেবে গ্রাহাম গুচের নেই, অ্যালিস্টার কুক সেটা করে ফেলেছেন। ভারতে টেস্ট জিতে। বিষাদে আক্রান্ত টিমকে ধোনি বার্তা দিয়েছেন: ‘মুষড়ে পড়ে কী লাভ? চলো, ইডেন থেকে নতুন করে শুরু করি।’ কিন্তু ধোনিও বা নিজেকে কতটা উদাহরণ হিসেবে পেশ করতে পারছেন?
টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি তো বটেই, তাঁর উইকেটকিপিং নিয়েও কিন্তু দেদার প্রশ্ন উঠছে। সোমবার অশ্বিনের প্রথম বলটাই যে ভঙ্গিতে পায়ের তলা দিয়ে ফস্কালেন, সেটা কলকাতার কোনও কোচিং সেন্টারের কিপার করলে দ্বিতীয় দিন চৌকাঠ পেরোনোর অনুমতি মিলত কি না সন্দেহ।
ধোনির স্ট্র্যাটেজি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শেন ওয়ার্ন শুনিয়ে রাখলেন, “ভারতের উচিত একেবারে র্যাঙ্ক টার্নারে না নেমে এমন উইকেট বানানো যেখানে ব্যাটিংটাও করা যাবে।” অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তির মতে, মুম্বইয়ে সোয়ান আর অশ্বিনের তফাত হয়ে গেল ‘রিস্ট রেভলিউশনে’। র্যাঙ্ক টার্নারে ফারাকটা ধরা পড়বে। কিন্তু একটু ব্যাটিং উইকেটে তত নয়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হচ্ছে, ইডেনে এত খারাপ হবে না টিম ইন্ডিয়ার। “ইডেন উইকেটের মাটি নতুন। ব্যাটসম্যানরা সাহায্য পাবে,” বলছিলেন সৌরভ।
কিন্তু তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, কবে আর বিশেষজ্ঞদের কচকচানিতে কান দিয়েছেন? তিনি যা ঠিক করবেন, যা ভাববেন, সেটাই ঠিক। ভারতীয় ক্রিকেটে সেটাই এখন নিয়ম। সংবিধান বললে, সংবিধান।
তাই টেস্ট যতই সওয়া তিন দিনে সাফ হোক, মন্টির স্পিনে যতই কচুকাটা হোক তাঁর ব্যাটিং লাইন আপ, তবু ভারতীয় ক্রিকেটের এমএসডি বলে যাবেন, “অতশত বুঝি না। ইডেনেও আমার এমন টার্নারই চাই!”
|
ভারত প্রথম ইনিংস ৩২৭ |
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস ৪১৩ |
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১১৭-৭) |
গম্ভীর এলবিডব্লিউ সোয়ান ৬৫,
হরভজন ক ট্রট বো সোয়ান ৬,
জাহির ক প্রায়র বো পানেসর ১,
প্রজ্ঞান নঃআঃ ৬,
অতিরিক্ত ৯,
মোট ১৪২।
পতন: ৩০, ৩৭, ৫২, ৬৫, ৭৮, ৯২, ১১০, ১২৮, ১৩১।
বোলিং: অ্যান্ডারসন ৪-১-৯-০, পানেসর ২২-৩-৮১-৬, সোয়ান ১৮.১-৬-৪৩-৪।
|
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস |
কুক নঃআঃ ১৮,
কম্পটন নঃআঃ ৩০,
অতিরিক্ত ১০,
মোট ৫৮-০।
বোলিং: অশ্বিন ৩.৪-০-২২-০, প্রজ্ঞান ৪-০-১৬-০, হরভজন ২-০-১০-০। |
|
|
|
|
|
|
|