এক দিকে উন্নাসিকতা, অন্য দিকে সুযোগসন্ধানী আচরণ।
আমাদের বিদ্বজ্জনদের সমস্যাও কম নয়। লিখছেন মানবাধিকার কর্মী আনন্দ মুখোপাধ্যায় |
সম্প্রতি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ এ রাজ্যে শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার কারণ রূপে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ও বর্তমান সরকার উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এ দিকে, দেশ জুড়ে শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখনও অণ্ণা হজারে ও তাঁর সতীর্থরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অণ্ণা হজারের দলের অন্যতম প্রধান সৈনিক অরবিন্দ কেজরিওয়াল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাজনৈতিক দল গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সুশীল/নাগরিক সমাজের একাংশ অবশ্য অরবিন্দের পথে পা বাড়াতে রাজি নয়।
সারা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার পিছনে অনেকগুলি কারণের কথা ভাবা যায়। প্রথমত, অস্বীকার করার উপায় নেই, নাগরিক সমাজের বিদ্বজ্জনরাই মানসিক ভাবে ‘আমরা-ওরা’-য় আক্রান্ত। মনে দলীয় আনুগত্যবোধ কাজ করলে নাগরিক সমাজকে বলশালী করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিক সমাজ সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ, গুলিচালনার মতো জ্বলন্ত বিষয়গুলি নিয়েই প্রতিবাদ-আন্দোলনে শামিল হয়। ক্ষুধাজনিত কারণে মৃত্যু, চাষিদের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, আর্সেনিক সমস্যা, পরিশ্রুত পানীয় জলের চাহিদা, ছিটমহল সমস্যা প্রভৃতি নানা ধরনের জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধানের দাবি নিয়ে নাগরিক সমাজকে প্রবল শক্তিতে পথে নামতে তেমন দেখা যায় না। জনজাতি-আদিবাসী-প্রান্তিকবর্গের মানুষগুলির দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে ও আর্থিক, সামাজিক দাবিদাওয়া নিয়েই বা শহুরে বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজ তেমন সক্রিয় কোথায়? বাম-আমলে লালগড় সহ জঙ্গলমহল সংবাদের শিরোনামে আসার পর সে অঞ্চলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিত্য যাতায়াত শুরু হয়। ইদানীং গুলির লড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের দাবিদাওয়া নিয়ে তার গলা ফাটানো মিইয়ে যাচ্ছে কেন? তা হলে কি শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের তাগিদেই নাগরিক সমাজ আদিবাসী মানুষগুলির বঞ্চনা ও অধিকার নিয়ে সরব হয়েছিলেন?
তৃতীয়ত, সরকার বদলের পর ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় নাগরিক সমাজের একাংশ প্রতিবাদী চরিত্র খুইয়ে জনগণের চোখে অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির কাছে মাথা নুইয়ে সরকারের অনুরাগভাজন হতে চান, এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আমরা বিগত জরুরি অবস্থার সময়েই প্রত্যক্ষ করেছি। এই সমাজের তথাকথিত দিক্পালরা সে দিন অনেকেই দিক্ভ্রান্ত হয়ে সরকারি ভাষ্যের দোসর হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে আবার করে দু’নৌকায় পা রেখে চলেছিলেন।
সমাজে এই ধরনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলে কোনও মতেই শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। বিগত পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে এই ধরনের দৃষ্টান্তের ধারাবাহিকতাই লক্ষ করা যাচ্ছে আমাদের সমাজে।
শেষে বলি, নাগরিক সমাজের গভীর পাণ্ডিত্য ও উন্নাসিকতার ভারে আমজনতা ন্যুব্জ। খেটে-খাওয়া মানুষ, কৃষক-মজুর, ভাগচাষিদের অংশগ্রহণ সেখানে শূন্য বললেই চলে, নাগরিক সমাজই সর্বেসর্বা। তাদের মতামত সব ক্ষেত্রে আমজনতা মেনে নেবে কেন? |