|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
দ্বিতীয় দফায় তাঁর কাজটা আরও অনেক কঠিন |
একটা যুদ্ধ কোনও রকমে জিতেছেন। আরও বড় যুদ্ধ সামনে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার
প্রতিপক্ষ এ বার দেশের ঐতিহাসিক আর্থিক সংকট। যুদ্ধে জয় না পেলে গোটা দেশটারই
হুড়মুড় করে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ভারতের পক্ষেও সেটা ভাল হবে না। পরীক্ষিৎ ঘোষ |
কাগজের সমীক্ষা বলছিল লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে। শেষমেশ ওবামা নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু গত বারের বিপুল জয় আর জনসমাদর এ বার আর জোটেনি। দ্বিতীয় দফায় তাঁর কাজটা আরও কয়েক গুণ কঠিন। কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বেন বার্নাঙ্কে সম্প্রতি বলেছেন, আমেরিকার সামনে একটা গভীর আর্থিক খাদ হাঁ করে রয়েছে। খুব শিগ্গির কিছু একটা না করলে হুড়মুড় করে সেখানে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা।
কথাটা মিথ্যে নয়। বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিশেষ বিল পাশ করে বিভিন্ন করের হার অনেক কাটছাঁট করা হয়েছিল। এ বছরের শেষে তার মেয়াদ ফুরোবে, একগাদা নতুন করের বোঝা লোকের ঘাড়ে এসে পড়বে। অন্য দিকে, সরকারি ব্যয়ের ওপর বড়সড় কোপ বসতে চলেছে। ২০১১-র মাঝামাঝি মার্কিন কংগ্রেস ঋণসীমা (অর্থাৎ, সরকার কত টাকা ধার করতে পারেন) বাড়াতে গিয়ে বেঁকে বসেছিল, ফলে সরকারি বন্ড তামাদি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে একটা রফা হয়, তবে একটা শর্তে। ২০১৩ সালের গোড়া থেকেই বাজেটে খরচ ছাঁটাই করা চাই। সেটাই ঘটতে চলেছে।
আর্থিক মন্দার সময় মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেয়, জিনিসপত্রের চাহিদা পড়ে যায়, কলকারাখানা বন্ধ হয়, বেকারসংখ্যা বাড়ে। চাহিদার কমতি মন্দার কারণও বটে, উপসর্গও বটে। এ রোগের ওষুধ, সরকারকে খরচ বাড়িয়ে আর করের বোঝা কমিয়ে বাজারে চাহিদা চাঙ্গা করে রাখতে হবে, যত ক্ষণ না অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফিরে আসে। ক্ষমতায় এসেই ওবামা ধরেবেঁধে ৭৮,০০০ কোটি ডলারের ‘স্টিমুলাস’ বিল পাশ করান। তার দৌলতে মন্দার ঝাপ্টা ইউরোপের তুলনায় আমেরিকার ওপর দিয়ে কম গেছে। এখন স্টিমুলাসের উল্টোটা ঘটার উপক্রম। রোগীর অক্সিজেন বন্ধ হল বলে। |
|
ক্ষণস্থায়ী? দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার জয়ের সংবাদে
জনতার উল্লাস। শিকাগো, ৭ নভেম্বর, ২০১২। ছবি: এ পি |
যে সব আইন অনুযায়ী এটা ঘটতে চলেছে, সেগুলো এখনও বদলানো যায়। তবে বদলাতে গেলে তিন পক্ষের সম্মতি লাগবে: প্রেসিডেন্ট, সেনেট (মার্কিন ‘রাজ্যসভা’) এবং হাউস (মার্কিন ‘লোকসভা’)। প্রেসিডেন্ট আর সেনেট এখন ডেমোক্র্যাটদের দখলে, কিন্তু হাউসে রিপাবলিকানরাই দলে ভারী। সেটাই মুশকিল। দুই দলের কাজিয়া এখন তুঙ্গে। ভবিষ্যতে আমেরিকার সমাজব্যবস্থা কী রূপ নেবে, দারিদ্র আর বৈষম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ নিয়ে দুই মতাদর্শের সংঘাত অনেক দিন ধরেই বহমান।
|
গগনে গরজে |
গত তিন-চার বছর ধরে ইউরোপ আমেরিকার ধনী দেশগুলোয় হ্যারিকেন স্যান্ডির মতোই একটা ঝড় ক্রমাগত বয়ে চলেছে। আসলে ঝড় তো একটা নয়, অনেকগুলো। খুলে বলা যাক।
১) অর্থনৈতিক দুর্নীতি। ফাইনান্সের দুনিয়ায়, বিশেষত ওয়াল স্ট্রিটে, বহু অপকর্মের খবর ইদানীং ফাঁস হয়েছে। এঁদের কাজই হল গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো, অর্থাৎ অপরের টাকাকড়ি সামলানোর ভার নিয়ে নিজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো। কিন্তু তাই করতে গিয়ে বেপরোয়া ঝুঁকি নিয়েছেন, নিজেদের মোটা বোনাস দিয়েছেন।
২) ব্যাঙ্কিং সংকট ও আর্থিক মন্দা। অনেক বড় কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, সরকার দেউলিয়া হওয়ার মুখে, ফলে কেউই নতুন করে ধার দিতে চাইছেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভাটা পড়েছে। মন্দার সময় চারি দিকে ব্যয়সংকোচের হিড়িক পড়ে, তাতে মন্দা আরও জাঁকিয়ে বসে।
৩) বাজেট ঘাটতি ও জাতীয় ঋণ। গ্রিস, স্পেন, ইতালিতে জাতীয় ঋণ এখন এমন আকার ধারণ করেছে যে, সরকার ধার মেটাতে পারবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ। মার্কিন সরকারের ঋণের বোঝাও হু-হু করে বাড়ছে।
৪) আর্থিক বৈষম্য। গোটা উন্নত বিশ্ব জুড়েই গরিব ও বড়লোকের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আমেরিকায় ব্যাপারটা সবচেয়ে দৃষ্টিকটু। জাতীয় আয়ের ২৫ শতাংশ আর জাতীয় সম্পত্তির ৪০ শতাংশ এখন মাত্র ১ শতাংশ লোকের দখলে। এতটা বৈষম্য শেষ দেখা যায় বিশের দশকে, মহা-মন্দার আগে।
আমেরিকায় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে চাপা বিক্ষোভ তাই বাড়ছে। দলীয় রাজনীতির গণ্ডির বাইরে টি পার্টি অথবা ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ জাতীয় জন-আন্দোলনের মধ্যে তার প্রমাণ। এর মূলে রয়েছে আর্থিক বৈষম্য। কিন্তু বৈষম্যের উৎপত্তি কোথায়? দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকানরা সরকারি খবরদারি আদপেই সহ্য করতে পারেন না। বাজারি অর্থনীতির এই পূজারিরা মুখে ফেনা তুলে বলে চলেছেন, বাজেট ঘাটতিই সব সমস্যার মূলে, অতিরিক্ত করের বোঝা আর সরকারি অপচয় অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছে। এ সব ছেঁটে ফেললেই দেশ আবার ধন-ধান্যে ভরে উঠবে। বামঘেঁষা ডেমোক্র্যাটরা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই সন্দেহের চোখে দেখেন। এঁরা ওয়াল স্ট্রিটের দুর্নীতি, কর্পোরেট জগৎ ও নেতাদের যোগসাজশ নিয়ে পাড়া মাত করছেন। দালালির পুঁজিবাদকে (crony capitalism) কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন।
মন্দা ও দীর্ঘমেয়াদি বৈষম্য, দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে। মন্দা চলেছে বছর তিনেক, হয়তো দু’-এক বছরের মধ্যেও মিটেও যাবে। বৈষম্য বেড়েছে ত্রিশ বছর ধরে। মন্দা কাটলেও মার্কিন সমাজে সাম্য ফিরে আসবে না। বৈষম্য বাড়ার পিছনে অর্থনীতির গভীর অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রিয়াশীল। বিশ্বায়ন, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এর প্রধান কারণ।
|
এক সূত্রে |
কিছু দিন আগেও মার্কিন অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলতে বোঝাত ডেট্রয়েটে গাড়ি তৈরির আখড়া বা পিটসবার্গে ইস্পাতের কারখানা। ১৯৬৫ সালে জাতীয় উৎপাদনের ২৫ শতাংশ ছিল ভারী ও হাল্কা শিল্প, এখন তা ১১ শতাংশে নেমে দাঁড়িয়েছে। এই জাতীয় কলকারখানা অনেক দিন হল তল্পিতল্পা গুটিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দিকে পাড়ি দিয়েছে, যেখানে শ্রমিকদের মাইনেকড়ি অনেক কম। গাড়ির কারখানায় বা কাপড়ের মিলে কাজ করতে গেলে উচ্চশিক্ষার তেমন প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমেরিকার নয়া অর্থনীতিতে যে ধরনের চাকরি-বাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেখানে অন্তত কলেজ পাশ করা জরুরি। ও দেশে উচ্চশিক্ষার খরচ অনেক, শ্রমিকদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন। বাকি দুই-তৃতীয়াংশের ঘাড়েই কোপটা পড়েছে।
চিনে তৈরি শস্তা পণ্যে মার্কিন বাজার অনেক দিন ছেয়ে গেছে। শুধু কারখানায় তৈরি জিনিস নয়, অনেক রকম পরিষেবাতেও মার্কিন শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। মার্কিন ক্রেতা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফোন করলে ধরেন বেঙ্গালুরু বা গুড়গাঁওয়ের কল সেন্টার কর্মী, চিকিৎসার খরচ কমাতে রোগীরা মুম্বই আসছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাজারি গবেষণার কাজটাও ভারতে পাচার করছে। ধোপা-নাপিত বিদেশ থেকে আমদানি করা কঠিন, তাই রক্ষে।
এখানে একটা কথা খোলসা করা ভাল। বিশ্বায়ন-বিরোধী একটা অতি-সরলীকৃত মতাদর্শ আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলে চালু আছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে কিছু লোকের রুজি-রোজগারে টান পড়ে ঠিকই, কিন্তু অন্য অনেকের নতুন কাজ জোটে, উৎপাদনশীলতা বাড়ে, ক্রেতারা সেরা জিনিসটা সুলভে পান। মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে অনেকেই গোটা ব্যাপারটাকে পুঁজির মালিক আর শ্রমিকস্বার্থের সংঘাত হিসেবে দেখেন। আসলে বিশ্বায়ন প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের মধ্যে একটা টক্কর তৈরি করেছে। আমেরিকায় চাকরির টানাটানি, মাইনেকড়ি নিম্নগামী। সেই মুদ্রারই অন্য পিঠ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের আশ্চর্য উন্নতি। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শিল্পায়নের পথে দুটো বড় বাধা। প্রথমত, বিনিয়োগের অভাব। দ্বিতীয়ত, আধুনিক পণ্য কেনার খদ্দের খুব বেশি নেই। উন্নত দেশগুলোর পুঁজি আর বাজার তাদের কাছে খুবই জরুরি। সারা পৃথিবীর ইলেকট্রনিক্স পণ্যসামগ্রীর প্রায় অর্ধেক এখন চিনে তৈরি হয়, যাবতীয় আই-প্যাড আই-ফোন ওখান থেকেই বিশ্বের বাজারে আসছে। আমাদের দেশের শ্রমের মূল্য খুব কম হওয়া সত্ত্বেও আমরা চিনের মতো কায়িক শ্রমের আন্তর্জাতিক জোগানদার হয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু সফটওয়্যার বা কিছু কিছু পরিষেবার ক্ষেত্রে ইংরেজি বলিয়ে উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রা বিশ্বায়নের সুফলটুকু ষোলো আনা পেয়েছেন।
আমেরিকার ভাগ্যের সঙ্গে চিন বা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থ তাই ভাল রকম জড়িয়ে আছে। ও দেশে মন্দা চলতে থাকলে আমাদের পালেও হাওয়া লাগবে কম। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বৈষম্য যদি বাড়তেই থাকে, আমেরিকা তার শ্রমিকস্বার্থ বাঁচাতে অর্থনৈতিক ভাবে অন্তর্মুখী হয়ে পড়বেই। বিদেশে বিনিয়োগের ওপর বাধানিষেধ আরোপ হবে, আমদানি-রফতানির ওপরে চড়া শুল্ক বসবে। চিনের বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি মার্কিন রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের পীঠস্থানে বিশ্বায়নের ভরাডুবি ঘটলে আমাদের আখেরে ক্ষতিই, লাভ নয়।
|
কানা মামা |
রিপাবলিকানরা স্বদেশে ও বিদেশে বাজারি অর্থনীতির সমর্থক, অতএব চিন বা ভারতের তাঁরাই প্রকৃত বন্ধু এ কথা ভাবলে ভুল হবে। আগেই বলেছি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে মার্কিন সমাজে যে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা কমানোর কোনও একটা উপায় বের করতে না পারলে এর ওপর প্রবল রাজনৈতিক চাপ পড়তে বাধ্য। বিশ্বায়নও চলবে, গরিব আর বড়লোকের মধ্যে ব্যবধানটাও খুব বেশি বেড়ে যাবে না, এ কী করে সম্ভব?
ইউরোপে সুইডেন বা নরওয়ের মতো দেশগুলো কিছুটা পথ দেখিয়েছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মেলবন্ধন ঘটিয়ে। চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান, বেকার ভাতা এ সবের ভার যদি রাষ্ট্র হাতে তুলে নেয়, বড়লোকদের ওপর উঁচু হারে কর বসিয়ে যদি গরিব আর মধ্যবিত্তের জন্য আর্থিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা যায়, তা হলে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে জোরালো জনমত তৈরি নাও হতে পারে। রিপাবলিকানরা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে ওবামা এ নিয়ে এগোতে পারবেন বলে মনে হয় না। ২০১০ সালে আইন পাশ করে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সুলভে চিকিৎসা-বিমার বন্দোবস্ত হয়েছিল, প্রথম জমানায় ওবামার এটা বিরাট কৃতিত্ব। রমনি জিতলে এই আইন উল্টে দিতেন। তবে গরিবদের উন্নতির সিঁড়িটা যে বড্ড সরু, তার একটা বড় কারণ শিক্ষাব্যবস্থা। গরিব আর বড়লোকরা আলাদা পাড়ায় থাকেন। ইস্কুলের খরচ কেন্দ্রীয় সরকার জোগান না, ওটা উঠে আসে আঞ্চলিক ট্যাক্স থেকে। ফলে নিম্নবিত্ত এলাকায় ইস্কুলগুলোর অবস্থা বেহাল। গরিব ছেলেমেয়েরা শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্য ফিরিয়ে আনতে ওবামা যে উঠেপড়ে লাগবেন, এমন লক্ষণ দেখি না।
তবুও, নেই মামা-র চেয়ে তো ভাল!
|
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|