মণিপুরে রাষ্ট্র কি কোনও যুদ্ধে লিপ্ত? প্রশ্নটি কোনও পশ্চিমী মানবাধিকার সংগঠনের নয়। প্রশ্ন তুলিয়াছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। উপলক্ষ একটি জনস্বার্থ মামলা, যাহাতে অভিযোগ করা হয়, বিগত তিন দশকে এই রাজ্যে বিনা বিচারে অন্তত হাজার দেড়েক মানুষকে হত্যা করা হইয়াছে। এই সব নিধনই আসলে সরকারি ভাষ্যে ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’র ঘটনা, নিরাপত্তা রক্ষীরা ‘আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো’র ফলে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে। মণিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদের সশস্ত্র আত্মপ্রকাশের রাষ্ট্রীয় মোকাবিলার ইতিবৃত্ত স্মরণে রাখিলে এই নিধন-কাণ্ডের একটি প্রেক্ষিত পাওয়া যায়। তথাপি সুপ্রিম কোর্টের তরফে প্রশ্ন তোলার কারণ, বিচারের সুযোগ না দিয়া, আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ না দিয়া নিছক সন্দেহবশে এতগুলি মানুষকে হত্যা করার পরিচিত ও বহুশ্রুত অভিযোগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনের গভীর আশঙ্কা নিহিত আছে।
মণিপুর গণতান্ত্রিক ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ অঙ্গরাজ্য, যেখানে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ইত্যাদি বলবৎ রাখার দায় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রেরই। সেই রাজ্যে নিয়মিত বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অথচ জঙ্গি দমনের নামে ‘সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন’ প্রয়োগ করিয়া ‘অসম রাইফেল্স’ নামক আধা-সামরিক বাহিনীর হাতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার সঁপিয়া দেওয়া হইয়াছে। নির্বাচিত সরকার বা জনপ্রতিনিধিদের কাছে কার্যত এই বাহিনীর কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করার প্রয়োজন নাই। হাতে রহিয়াছে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র এবং তাহার যথেচ্ছ ব্যবহারের অপরিমেয় ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের যদি মনে হইয়া থাকে যে, এই অনাচার গণতন্ত্রের সহিত মানানসই নয়, তবে তাহার দোষ নাই।
শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সমীপে কংগ্রেস-শাসিত মণিপুরের সরকারি কৌঁসুলি বলার চেষ্টা করিয়াছিলেন, জঙ্গিরা যেহেতু নিরাপত্তা রক্ষীদের মারিতেছে, তাই নিরাপত্তা রক্ষীরাও জঙ্গিদের মারিবে। বিচারপতিরা স্বভাবতই জানিতে চাহিয়াছেন, সরকার তথা রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদীদের মতো আচরণ করিতে পারে কি না। মণিপুর যে ইতিমধ্যেই অসম রাইফেল্স-এর জওয়ানদের দমননীতির জন্য কুখ্যাত, এই রাজ্যেই যে ইরম শর্মিলা চানু এক যুগ ধরিয়া সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করার দাবিতে অনশনরত, এখানেই যে মণিপুরি মায়েরা অসম রাইফেল্স-এর সদর দফতরে বিবস্ত্র অবস্থায় জমায়েত হইয়া তাঁহাদের ধর্ষণ করার জন্য জওয়ানদের আহ্বান জানাইয়া ধিক্কৃত করিয়াছিলেন, শীর্ষ আদালতের তাহা স্মরণে আছে। তাই রাজ্যকে নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় আরও যত্নশীল হইতে আদালত নির্দেশ দিয়াছে। মণিপুর সরকার আদালতের ভর্ৎসনা শিরোধার্য করিয়া আপন আচরণ সংশোধন করিবে, এমন সম্ভাবনা কম। কেননা তাহা করিতে গেলে সর্বাগ্রে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো অগণতান্ত্রিক একটি কানুন প্রত্যাহার করিতে হয়। ইম্ফল যদি বা তাহাতে সম্মত হয়, নয়াদিল্লি হইবে না। কারণ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মূলেই রহিয়াছে এই কেন্দ্রাভিগ প্রবণতা। |