|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
সতীত্ব, পুরুষতন্ত্র, সমাজ |
‘নিজের শরীরের চূড়ান্ত অধিকার নিজের’ এই সুরে রচনাটি বেঁধে ‘মেল শভিনিজম’কে কটাক্ষ করেছেন সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (‘সতীত্ব, ফুঃ’, রবিবাসরীয়, ৪-১১)। যুক্তিগুলি অনস্বীকার্য। কিন্তু তাঁর দর্শন যদি অন্যান্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তা হলে আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। আমরা আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাব। তার থেকে নারী-পুরুষ না-দেখে শুধুই মানুষ দেখুন না।
মানছি, বুদ্ধ্যঙ্কের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে, নারী-পুরুষ সমান। কিন্তু শারীরিক ভাবে নারী পুরুষের থেকে দুর্বল। তার চেয়ে বড় কথা, জীবনবিজ্ঞানগত ভাবে নারী আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাসম্পন্ন। একটা গোটা জাতি যদি দুর্বল হয়, তারা তো অন্য সবল জাতির দ্বারা অত্যাচারিত হবেই।
আর, পুরুষ কর্তৃক আরোপিত কুপ্রথাগুলি দূর করতে যুগে যুগে যে সব মানুষ এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা নারীতান্ত্রিকও নন, পুরুষতান্ত্রিকও নন। এ দেশে আজ যে মেয়েরা স্কুল-কলেজে গিয়ে পড়াশোনা করছে, বাসে-ট্রামে চড়ে অফিস-কাছারি করছে, অল্পবয়সি বিধবারা নতুন করে সংসার পাতছে এ সব কিছুর মূলে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি এক জন পুরুষ ছিলেন। মানবতাবাদী পুরুষ। নাম তাঁর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। খড়্গপুর
|
¶ ২ ¶ |
‘তন্ত্র’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ব্যবহার, নিয়মাদি, পরিরক্ষণ বা শাসন। মানুষ যখন তার নিজের প্রয়োজনে যূথবদ্ধ হল অর্থাৎ গোষ্ঠী বা দল তৈরি করল, তখন থেকেই কোনও না কোনও তন্ত্রের অধীনে সমাজবদ্ধ হল। গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমাজের উত্তরণ ঘটল। আবার নিজের প্রয়োজনেই মানুষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন ঘটাল। সামাজিক দিক থেকে গোষ্ঠীতন্ত্র, মাতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র এসে তার সমাজকে সুস্থিরতা বা শৃঙ্খলাবদ্ধতা (শৃঙ্খল নয়) দানের প্রয়োজনে কিছু সামাজিক নিয়মবিধি বা তন্ত্রের (সোশ্যাল কোড) অলিখিত ভাবে প্রচলন হল। কোডগুলি প্রয়োজনের তাগিদে পরিবর্তিত হতে লাগল, এখনও হচ্ছে, কিন্তু উঠে যাচ্ছে না। |
|
পুরুষশাসিত সমাজ যদি আবার কোনও দিন নারীশাসিত সমাজে পরিণত হয়, তাও হবে মানুষের প্রয়োজনে সময়ের চাহিদা মেনে এবং সেখানেও সোশ্যাল কোড থাকতেই হবে সমাজকে সুস্থিতি বা শৃঙ্খলা দেওয়ার জন্য।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ব্যবহারবিধি অনুসারেই পুরুষ বা নারীর ইজ্জত রক্ষিত হয়। যে কোনও নারী-পুরুষেরই নিজের শরীরের অধিকার তার একান্ত ব্যক্তিগত। সেই জন্য কোনও সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ বা নারী যদি মনে করে, টাকার বিনিময়ে সে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় প্রকাশ্যেই চলাফেরা করবে, এমনকী তার নগ্ন অবস্থাকে স্বেচ্ছায় পণ্য হিসাবে বিক্রি করবে, তবে বর্তমান পুরুষতন্ত্রে তা কি গ্রাহ্য হবে বা হওয়া উচিত?
অশোককুমার সাহা। চাঁদপাড়া বাজার, উত্তর চব্বিশ পরগনা
|
¶ ৩ ¶ |
যে সমাজে অর্থ বিনিময় ভিত্তিক যৌনতা (পুরুষ ও নারী উভয় ক্ষেত্রে) সভ্য সমাজকে একটা প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে বেঁধে রেখেছে, সেখানে বিষয়টিকে নৈতিক বৈধতা দিলে ক্যাটরিনার বয়সি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হবে।
নিজের দেহের অধিকার নিজেরই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে স্বেচ্ছাচারিতার শিখরে নিয়ে গিয়ে পণ্যে পরিণত করতে হবে। আরও এক বার মনে করিয়ে দিতে চাই ইউক্রেনের কলেজছাত্রীদের প্ল্যাকার্ডগুলির কথা, যেখানে লেখা ছিল, “Ukrainian girls are not for sale, Ukraine is not a Brothel.”
ঋষভ ঘোষ। গড়িয়া, কলকাতা-৮৪
|
¶ ৪ ¶ |
অতি আধুনিক প্রগতিশীল লেখিকাও কি ‘বেশ্যা’ বা ‘রেন্ডি’ শব্দ দুটিকে আপত্তিকর মনে করেন? এত কিছুর পরেও! ‘বেশ্যা’কে ‘খরিদ্দার’ টাকার বিনিময়েই ভোগ করে, গায়ের জোরে নয়। সেও টাকার বিনিময়েই নিজের ইচ্ছা বিসর্জন দেয়। ক্যাটরিনাও তো তাই-ই করেছেন। তফাতটা কোথায়?
দেবাশিস দাশগুপ্ত। শ্যামনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা
|
¶ ৫ ¶ |
কুড়ি বছর বয়সি ব্রাজিলীয় তরুণী ক্যাটরিনা যে দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিল, তা সত্যিই তথাকথিত সভ্য সমাজের (যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষশাসিত এবং পুরুষদের প্রচলিত অনুশাসন ও নিয়মের নিগড়ে বাঁধা) মুখে সজোরে চপেটাঘাত করল। আমার মতে, ক্যাটরিনার নিজের শরীর ও যৌবন সম্বন্ধে যে চূড়ান্ত ব্যবসায়িক মনোভাব ও সিদ্ধান্ত, তা সত্যিই তার একান্ত ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে কারও কোনও মত থাকা অনুচিত। যদিও কাগজে-কলমে বা সব সময়ের ব্যবহারিক জীবনে আমরা নারী-পুরুষ সমান বলে থাকি, তথাপি পুরুষেরা বা এই সমাজ এখনও নারীকে তার একান্ত নিজস্ব ভোগ্যবস্তু হিসেবে মনে করে। পুরুষেরা বহুগামী হতে পারে বা তার কৌমার্য অনায়াসে সগর্বে যখন-তখন বিসর্জন দিয়ে পুরুষের তকমা ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু কোনও নারী যদি এটা সর্বসমক্ষে সদর্প ঘোষণা করে, তা হলেই সে বেশ্যা পরিচিতি লাভ করে।
আমার শরীরের উপর সম্পূর্ণ অধিকার আমার। আমার বিষয়সম্পত্তি, গয়নাগাঁটি, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর যদি আমার ব্যক্তিগত অধিকার থাকে, তা হলে শরীরের উপর তা থাকবে না কেন?
‘সতীত্ব’ বা ‘Virginity’ তকমাটা পুরুষশাসিত সমাজই নারীদের দিয়েছে। প্রত্যেক পুরুষই চায়, বাসরঘরে ফুলশয্যার রাতে সে যে নারীকে ভোগ করবে, সে হবে ‘Brand New’ সিল-খোলা এক সম্পূর্ণ যৌবনবতী নারী। তাই বিয়ের আগেই যদি সে তার ‘সতীত্ব’ খোয়ায়, তা হলে সমাজের চোখে সে নষ্টা। ক্যাটরিনা এই ‘সতীত্ব’কে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে শরীর নামক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে যে ব্যবসায়িক ডিল করেছে, তাতে সমস্ত পুরুষসমাজ নড়েচড়ে বসেছে। তাদের পৌরুষে আঘাত লেগেছে। তারা ভাবছে, নারীকে হয়তো আর তাদের একচ্ছত্র মালিকানায় বেঁধে রাখা যাবে না।
আমিও বিশ্বাস করি, কোনও নারীর সম্মান তার ‘যোনি’-তে নেই। আছে তার শিক্ষায়, রুচিতে, ব্যবহারে সর্বোপরি তার হৃদয়ে। এমন অনেক নারী পূর্বেও ছিলেন, এখনও আছেন, যাঁরা ‘স্বামী’ নামক অপরিচিত প্রথম দেখা পুরুষটির কাছে ফুলশয্যার রাতে তাঁর ‘সতীত্ব’ বা virginity সমর্পণ করে দেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, জীবনে সুদীর্ঘ ৪০-৫০ বছর তাঁরা একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও কেউ কারও হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে পারেননি, কেউ কারও প্রেমাস্পদ হয়ে উঠতে পারেননি। হয়তো সংসারের বা সমাজের তাগিদে বা সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তাঁরা একত্রে থেকে গেছেন। কিন্তু মনের মিল কখনওই হয়নি।
এষা চক্রবর্তী। সল্টলেক, কলকাতা-৬৪ |
|
|
|
|
|