হারানো ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কসাবের হামলাই |
হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনায় বসেছিলেন বছর ষাটের মহম্মদ ফজরুদ্দিন। দু’চোখ বেয়ে জল।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে বাড়িটার চেনা ছন্দ পাল্টে গিয়েছে। ঠিকানা: হরিপুর, ডালখোলা, উত্তর ২৪ পরগনা। হঠাৎই খবর আসে, মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে গুলি খেয়ে নিথর ফজরুদ্দিনের আঠারো বছরের ছেলে হাসিবুর। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিয়ে মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তিনি। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরবেন বলে সকলের জন্য উপহার কিনে ফেরার ট্রেন ধরতে আসেন। তখনই গুলি!
এর পর থেকে পাড়ার চায়ের দোকান, বাসস্টপ, স্টেশনে যেখানেই যার সঙ্গে দেখা হত, ফজিরুদ্দিন জানতে চাইতেন আজমল কসাবের কবে সাজা হবে। হতদরিদ্র দিনমজুরের বাড়িতে টিভি নেই, রেডিও-ও নেই। প্রথম যখন কাসভের ফাঁসির আদেশ শোনেন, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে স্ত্রী জলেবা বিবিকে খবর দিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। জলেবা বিবির কথায়, “পাড়ার দোকানে ফোন করে ছেলে বলত, ‘মা চিন্তা কোরো না। বাবাকে আর মাঠে-ঘাটে কাজ করতে হবে না। ভাইবোনদের পড়াব।’ ছেলে চলে যাওয়ায় ওর বাবা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল।” ক্লান্ত গলায় ফজরুদ্দিন বলেন, “একটা খুনির শাস্তি হল। কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।” |
মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় প্রত্যন্ত গ্রাম বদুয়া থেকে ছোটখাটো কাজ নিয়ে মুম্বই গিয়েছিলেন আসফার শেখ। ভাইবোনদের পড়াশোনা করাতে হবে, বোনের বিয়ে দিতে হবে! সারা দিন কাজের পরে রাত কাটাতেন সিএসটি স্টেশন চত্বরে। সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর শরীর।
এর পরে চার বছর কেটেছে। আসফারের বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই রেলে চাকরি পেয়েছেন। আসফারের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণের টাকাও এসেছে। চোখের জলে ভেসে বোন আজিরুন্নেসা বিবি বলেন, “সংসারে সুখ এসেছে। কিন্তু দাদা নেই।” তাঁর বাবা, দিনমজুর আল্লারাখা শেখ বলেন, “আজ আমাদের যা মনের অবস্থা, গোটা দেশের মানুষের তা-ই। আমরা বিচার চেয়েছিলাম।”
হুগলির সিঙ্গুরে বিচার চেয়েছিল মীরা চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারও। নতুনবাজারের বাড়িতে বসেও তাঁর ছেলে পূর্ণেন্দুর মনে পড়ে, মা গিয়েছিলেন মুম্বইয়ের নালাসোলে বড় ছেলে অর্ধেন্দুর কাছে। সে দিন ফেরার কথা ছিল। মা আর স্ত্রীকে সিএসটি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে অর্ধেন্দু বাড়ি গিয়েছিলেন আরও মালপত্র আনার জন্য। যখন ফিরলেন, তত ক্ষণে গুলি-গ্রেনেডে তছনছ হয়ে গিয়েছে স্টেশন। পুত্রবধূর চোখের সামনেই ৬৬ বছরের বৃদ্ধার বুক ফুঁড়ে দেয় সন্ত্রাসবাদীদের গুলি। কসাবের ফাঁসির খবর পাওয়া ইস্তক টিভি থেকে চোখ সরাতে পারেননি পূর্ণেন্দু আর তাঁর স্ত্রী গীতা। তবে তাঁদের সংশয়, “কোনও এক জনকে ফাঁসি দিলেই কি কাজ শেষ হয়ে যায়? একটা বিষধর সাপ হয়তো মরল। কিন্তু সাপের বাসাটা থেকেই গেল। কবে এই সন্ত্রাস শেষ হবে?”
খুশি হলেও মাতামাতি করতে পারছেন না বর্ধমানের চিত্তরঞ্জনে পূর্ণচন্দ্র দাসও। সেই আতঙ্কের দিনটাই তো তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছিল ১৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মেজো ছেলেকে! মাত্র ১৪ বছর বয়সে উধাও হয়ে যায় সেই ছেলে। নাম প্রশান্ত। কাসভদের হামলার দু’দিন পরে খবরের কাগজে আহতের তালিকায় বাবা-মায়ের চোখে পড়ে সেই নাম! গুলি খেয়েছে টার্মিনাসে।
এ কি সে-ই? না কি নাম এক, মানুষটা আলাদা? দুরুদুরু বুকে ট্রেনের টিকিট কেটে স্ত্রী আর বড় ছেলেকে নিয়ে মুম্বই ছোটেন পূর্ণবাবু। জে জে হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন, শুয়ে আছে ছেলে! মাসখানেক থেকে সুস্থ ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।
প্রশান্ত আবার মুম্বই ফিরে গিয়েছেন। সরকার পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। তা পথশিশুদের দেওয়ার জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলকে চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর দফতর জানিয়ে দেয়, ওই টাকা প্রশান্তকেই খরচ করতে হবে। অগত্যা ক্ষতিপূরণের টাকায় সামাজিক সংগঠন বানিয়ে তিনি পথশিশুদের জন্য কাজ করছেন।
পূর্ণচন্দ্রবাবু বলেন, “আমি তো ভাগ্যবান। ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। স্বজনহারাদেরই হয়তো আজ বেশি স্বস্তির দিন।” |