লক্ষ্য পঞ্চায়েত, মন্ত্রিসভায় বড় ঝাঁকুনি মমতার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ এনে এবং বড়সড় রদবদল ঘটিয়ে সরকার পরিচালনায় একটা ঝাঁকুনি দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ঠিক আগের দিন, মঙ্গলবার বেশ ক’টি দফতরে আমলাস্তরেও অদল-বদল করেছেন তিনি। রাজ্যের প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটকে পাখির চোখ করতেই মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন তৎপরতা।
বুধবার রাজভবনে ১৩ জন মন্ত্রী শপথ নেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে। এঁদের পাঁচ জনের পদোন্নতি পেলেন, বাকি আট জন মমতা মন্ত্রিসভায় প্রথম। এ ছাড়া বর্তমান ৮ মন্ত্রীর দায়িত্ব বদলও হয়েছে। যাঁরা নতুন এলেন ও যাঁদের পদোন্নতি হল, তাঁদের সিংহভাগই গ্রাম-বাংলার, যার মধ্যে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি মুর্শিদাবাদ-মালদহের পাশাপাশি ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে সিপিএমের দখলে থাকা বর্ধমানও রয়েছে। উপরন্তু যে জেলা পরিষদগুলোয় তৃণমূল সামান্য ব্যবধানে হেরেছিল, সেই সব জেলাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন, নদিয়ার পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা হয়েছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরির প্রতিমন্ত্রী। উল্লেখ্য, নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা আর্সেনিক-সমস্যায় জর্জরিতও বটে।
ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধি মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রীর পদে উন্নীত হয়েছেন। যার পিছনে উত্তর ২৪ পরগনায় বিপুলসংখ্যক মতুয়া ভোট ধরে রাখার উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে অনুমান। সেচ-খালের বেহাল দশার কারণে যে জেলার গ্রামীণ এলাকা ফি বছর ভেসে যায়, সেই হাওড়ার রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় (ডোমজুড়ের বিধায়ক) হয়েছেন সেচ-জলপথের নতুন পূর্ণমন্ত্রী। আবার যেখানকার জেলা পরিষদ কব্জায় থাকলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূল জেরবার, সেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুই বিধায়ককে নতুন প্রতিমন্ত্রী করেছেন মমতা। এঁরা হলেন কাকদ্বীপের মন্টুরাম পাখিরা ও মগরাহাটের গিয়াসুদ্দিন মোল্লা। নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ওই জেলারই শ্যামল মণ্ডলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে জেলাবাসীকে ‘সততা ও স্বচ্ছতা’র বার্তাও দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। সিঙ্গুর-আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা বেচারাম মণ্ডলও এ বার মমতা মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ।
কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর খাসতালুক মুর্শিদাবাদ থেকে দলত্যাগী হুমায়ুন কবীরকে প্রতিমন্ত্রী করে আনা হয়েছে। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তিনিই যে অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের ‘মুখ’ হবেন, এ দিন শপথ গ্রহণের পরে সে ইঙ্গিত দিয়ে হুমায়ুন বলেন, “অধীর চৌধুরী যদি বহরমপুরের হয়ে থাকেন, তবে মনে রাখবেন আমি রেজিনগরের হুমায়ুন কবীর। দিদির আশীর্বাদ নিয়ে লড়াইয়ের মাঠে নামছি। এক ইঞ্চি জমি ছাড়ব না।” ওই জেলার সুব্রত সাহাও প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। |
রাজনীতির তাগিদে কংগ্রেসের ঘাঁটি মালদহও রদবদলে গুরুত্ব পেয়েছে। একদা গনি-ঘনিষ্ঠ এবং কংগ্রেসত্যাগী সাবিত্রী মিত্রকে মমতা আগেই ক্যাবিনেট মন্ত্রী করেছিলেন। এ বার কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর মতো মালদহের ডাকাবুকো নেতাকেও কংগ্রেস থেকে এনে মন্ত্রী করেছেন মমতা। কলকাতাকে লন্ডন ও দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ড বানানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর উপরেই বর্তেছে। কৃষ্ণেন্দুকে জায়গা করে দিতে বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহকে ঠেলা হয়েছে ‘পরিকল্পনা’ দফতরে, যা এত দিন দেখতেন বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। ‘শস্যভাণ্ডার’ বর্ধমানে সিপিএম-কে চাপে ফেলতে স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তির ও ‘আদি তৃণমূল’ স্বপন দেবনাথকে করা হয়েছে ভূমি দফতরের প্রতিমন্ত্রী।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে কৃষি দফতরকে আরও সচল করতে মমতা দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিক মলয় ঘটককে। মলয়বাবুর কাছ থেকে আইন দফতর নিয়ে তার স্বাধীন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে। আর কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে আনা হয়েছে পরিসংখ্যানে। এই দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ হয়েছেন নতুন মৎস্যমন্ত্রী। পরিবহণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী মদন মিত্র পূর্ণমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন। আবাসন-যুবকল্যাণের প্রতিমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও তা-ই। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানমন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস হয়েছেন কারিগরি-শিক্ষামন্ত্রী।
তবে কিছু প্রশ্নও মাথা চাড়া দিয়েছে রাজনীতিক-প্রশাসনিক মহলে। যেমন, পরিবহণে নানা বিতর্কিত বিষয়ের সমাধানে ব্যর্থ মদন মিত্রকে কেন পূর্ণমন্ত্রী করা হল? কৃষিতে ঘুঘুর বাসা ভাঙার পরেও রবীন্দ্রনাথবাবুকে কম গুরুত্বের দফতরে পাঠানোর কারণ কী? বেচারামবাবুকে কৃষি এবং আইসিডিএস প্রকল্পের প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কোন সাফল্যের সুবাদে অরূপ বিশ্বাস পূর্ণমন্ত্রী হলেন? উপরন্তু মমতা নিজেই যেখানে কারিগরি-শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন, সেখানে দু’বার দফতর বদলানো উজ্জ্বলবাবুকে নিয়ে আসাটাও অনেককে ধন্ধে ফেলেছে। দুবরাজপুরে লোবা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরেও চন্দ্রনাথবাবুর গুরুত্ব বাড়ানোটা দলের অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। “ওঁর জোরে বীরভূম জেলা পরিষদ সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা যাবে তো?” সংশয় প্রকাশ করেন বীরভূমের এক তৃণমূল বিধায়ক।
প্রশ্ন উঠেছে চন্দ্রিমাদেবীর শপথ নিয়েও। তিনি আগেও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, এখন তাঁকে স্বাধীন দায়িত্ব দেওয়া হল। এ জন্য তাঁকে এ দিন ফের শপথবাক্য পাঠ করানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না বলে দাবি করেছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম। |