বৃত্তের শুরু যাদের ঘিরে হয়েছিল, শেষ হল তাদের সামনেই।
প্রেক্ষাপট এক। চরিত্রেও বদল নেই। সেই ভারত বনাম ইংল্যান্ড। সেই কেভিন পিটারসেন। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আজমল কসাব। ফারাকের মধ্যে শুধু মাঝের চারটে বছর।
চার বছর আগের ২৬-১১-র রাত অসীম আতঙ্কে মুম্বইয়ের ব্যস্ত জনজীবনের হৃদযন্ত্র স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ মাঝপথে ফেলে দেশে পড়ি কি মরি করে ছুটতে হয়েছিল টিম পিটারসেনকে। মুম্বইয়ে পা না দিয়েই।
চার বছর পর ২১-১১-র সকাল আবার অন্য বিষাদে, নতুন আশঙ্কার স্রোতে ভাসিয়ে দিল আপামর মুম্বইকে। সেই ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের আবহেই। বিষাদ কসাবের আচমকা ফাঁসির খবরে নয়। পাক জঙ্গির নারকীয় হত্যালীলার ছবি যে আবার চোখের সামনে চলে এল! সঙ্গে আশঙ্কা কসাবের মৃত্যুসংবাদে যদি ফের বাণিজ্যনগরীর বুকে আছড়ে পড়ে কোনও নতুন জঙ্গিহানা? যদি নতুন করে ক্ষতবিক্ষত হয় গর্বের তাজ? |
সকাল ন’টায় চ্যানেলে-চ্যানেলে কসাবের মৃত্যুসংবাদ যখন চলছে, অ্যালিস্টার কুক তখন দলবল নিয়ে ওয়াংখেড়ের গেটের দিকে হাঁটছেন। নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, সাড়ে ন’টা থেকে প্র্যাক্টিস। টিম ধোনি সবে ব্রেকফাস্ট সেরে উঠেছে। তাজের ভিতর থেকে আঁচ পাওয়া যায়নি বাইরের উত্তপ্ত আবহাওয়ার। একে ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের উত্তেজনা, ২-০-র সৌরভ মুম্বই টেস্টের গায়ে লেপ্টে আছে, তার উপর এন শ্রীনিবাসন সমেত বোর্ডের রাঘববোয়ালদের নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। শহরের অশান্ত মেজাজের আন্দাজ প্রথম পেলেন বৈঠকে যোগ দিতে আসা সিএবি কর্তারা। বিমানবন্দর পেরতে না পেরতেই প্রবল ট্র্যাফিক জ্যাম। গাড়ি থামিয়ে পুলিশি ‘চেকিং’। তাজে ঢোকার প্রধান রাস্তা বন্ধ। হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছে সারি-সারি পুলিশের ‘পেট্রল কার’। হোটেলের ভিতরে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েনের কাজ শেষ। হবে না? আরব সাগরের পারে ততক্ষণে যে ‘রেড অ্যালার্ট’।
এবং নতুন করে রক্তক্ষরণেরও শুরু। বিভিন্ন দিকে, নানা চেহারায়, ভিন্ন সময়ে। চৌপাট্টিতে পুলিশ অফিসার তুকারাম আপ্তের মূর্তিতে রাশি-রাশি ফুল দিয়ে যাচ্ছে পথচলতি মানুষ। কেন? ওই চৌপাট্টিতে কসাবকে হাতেনাতে ধরতে গিয়ে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আপ্তের শরীর। এক মুম্বইকর আবার কাজ ফেলে জিটি হাসপাতালের উল্টো দিকের ব্যাঙ্কের দেওয়ালের গায়ে চার বছরের পুরনো বুলেটের দাগ দেখাচ্ছেন। বিলাপ করছেন, কী ভাবে ওই অভিশপ্ত দিনে কসাবের অতর্কিত হানায় লুটিয়ে পড়েছিলেন আরও দুই অফিসার অশোক কামটে ও হেমন্ত কারকারে। লিওপোল্ড কাফে চুপ। শোকের তীব্রতা এখনও এত যে, কসাব নিয়ে টুঁ শব্দ পর্যন্ত কেউ করতে চান না। ক্রিকেট সেন্টারের কর্তারাও বা আবেগ সরিয়ে রাখতে পারছেন কই? এক কর্তা তো বলেও ফেললেন, “ইংল্যান্ড সে বার চলে গিয়ে খুব খারাপ করেছিল। পরে যখন ফিরলই, তখন আগে যাওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু সে যা-ই হোক, মুম্বইও জীবনে ফিরতে জানে।” |
জানে যে, সেটা বোঝা গেল বিকেল নাগাদ। মুম্বই ক্রিকেট কর্তারাই বললেন, স্রেফ বুধবারই দশ লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে টেস্টের। ‘রেড অ্যালার্টের’ চোখরাঙানি সামলেই। সব মিলিয়ে, অঙ্কের হিসেবে আপাতত মোট তিরিশ। এবং স্টেডিয়াম ফুলহাউস না হলেও নব্বই শতাংশ যে ভর্তি থাকবে তাতে কারও কোনও সন্দেহ নেই। কার জন্য, সেটাও নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সহবাগের শততম টেস্টকে আপাতত ব্যাকফুটে ঠেলে, অনেক বড় ক্যানভাসে তিনি এবং ঘরের মাঠে তাঁর শেষ টেস্ট। এ দিনের প্র্যাক্টিসে চারটে ব্যাট নিয়ে নামামাত্র গ্যালারি থেকে যে চিৎকার উঠল, শুক্রবার থেকে সেটা গর্জনে বদলাবে। সব দেখেশুনে বিকেলের ওয়াংখেড়েতে দাঁড়িয়ে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার বলেই ফেললেন, “ওর খেলা ছাড়া নিয়ে কেন যে এত কথা হচ্ছে বুঝে পাচ্ছি না। ক্রিকেটীয় দক্ষতা ছেড়েই দিলাম। আবেগেও বা ওকে কে হারাবে?” ভারতীয় ক্রিকেটের সেই চিরন্তন তিন অক্ষরের নাম। এসআরটি। সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। বিষাদ-আশঙ্কার মুম্বইকে যিনি জীবনের সন্ধান দিচ্ছেন! |