নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
এ রাজ্যে সেট-টপ বক্স বসাতে দেরির কারণ হিসেবে রাজনীতিকেই কাঠগড়ায় তুলল মাল্টি সিস্টেম অপারেটর (এমএসও) সংস্থাদের একাংশ। তাদের দাবি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে গিয়ে এ রাজ্যে সেট-টপ বক্স চালু করার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রককে এমনটাই জানিয়েছে কলকাতা মেট্রো এলাকার অধিকাংশ এমএসও। কেন সেট-টপ বক্স চালু করা যাচ্ছে না, তা জানতে চেয়ে গত সপ্তাহে এমএসও সংস্থাগুলিকে হলফনামা পাঠাতে বলে কেন্দ্র। সোমবারই ছিল তা পাঠানোর শেষ দিন। রাজ্য সরকার কেন্দ্রের নির্ধারিত সময়সীমা ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সেট-টপ বক্স বসানোর বিরোধিতা করেছে।
এ দিকে, এ দিনই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে বলেন, “আমার খবর ঠিক হলে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মুখে ডিজিটাইজেশনের বিরোধিতা করলেও খাস মহাকরণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেট-টপ বক্স বসানোর অর্ডার গিয়েছে।” মণীশের দাবি, কলকাতায় ১৮.৫৭ লক্ষ বাড়িতে সেট-টপ বক্স বসেছে। তথ্য ও সম্প্রচার সচিব উদয়কুমার বর্মার হিসেবে, কলকাতায় ৯৩ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ।
কেন্দ্রকে দেয় হলফনামা নিয়ে আলোচনা করতে এ দিন দুপুরে পার্ক সার্কাসে বৈঠকে বসেন চারটি বড় এবং ১০টি মাঝারি ও ছোট এমএসও সংস্থার প্রতিনিধিরা। অধিকাংশেরই বক্তব্য ছিল, তাঁরা সেট-টপ বক্স আমদানির জন্য বহু টাকা লগ্নি করেছেন। কিন্তু বারবার রাজ্য সরকার ‘চাপ’ দেওয়ায় ‘ডিজিটাইজেশন’-এর কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁরা ক্ষোভ জানান। সে কথাই সরাসরি কেন্দ্রকে জানানোর দাবি ওঠে বৈঠকে।
শেষ পর্যন্ত বয়ানে লেখা হয়, এমএসও-রা কেন্দ্রীয় আইন মেনে ১ নভেম্বর থেকে অ্যানালগ সিগন্যাল বন্ধ করার কাজ করছেন। এই চিঠিতেই বিভিন্ন সংস্থা এ পর্যন্ত কতগুলি চ্যানেলের অ্যানালগ সিগন্যাল বন্ধ করেছে, সে কথা লেখা হয়। আগামী দিনে কী ভাবে কত চ্যানেলের অ্যানালগ সিগন্যাল বন্ধ করা হবে, তা-ও লেখা হয়।
এর সঙ্গেই বলা হয়, এই রাজ্যে সেট-টপ বক্স নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতার ঘটনাও ঘটছে। সে দিকে নজর রেখে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে সংস্থাগুলি। আরও বলা হয়, অ্যানালগ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, এমন কথা রাজ্যের তরফে বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও ১ নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মেনে এমএসও সংস্থাগুলির কেউ ৩৩, কেউ ১৯, কেউ ৪৬টি চ্যানেলের অ্যানালগ সিগন্যাল বন্ধ করেছে। প্রতিদিনই সেই বন্ধের সংখ্যা বাড়ছে বলে তারা চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে। তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি, তা চিঠিতে লেখা উচিত বলে বৈঠকে দাবি উঠলেও শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি।
এই হলফনামার প্রেক্ষিতে কেন্দ্র কী করবে? তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারী বলেন, “আমরা ধৈর্য ধরে আছি। আশা করব সব রাজ্যেই এমএসও-রা নির্ধারিত সময়সীমা মানবে।” মন্ত্রকের উপদেষ্টা যোগেন্দ্র পাল এ দিন দিল্লি থেকে বলেন, “কলকাতা, মুম্বই ও দিল্লির এমএসও সংস্থাগুলিকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, অ্যানালগ চালু আছে কি না। আগামী পনেরো দিন তাদের জবাব পরীক্ষা করে দেখব। কোনও সংস্থা অ্যানালগ চালানোর কথা স্বীকার করলে, তা সে যে চাপেই হোক না কেন, আমরা তার লাইসেন্স বাতিল করতে বাধ্য হব। শুধু ট্রাইয়ের সুপারিশ নয়, এটা করতে হবে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারেই। আমাদেরও এ ক্ষেত্রে হাত-পা বাঁধা।”
চ্যানেল থেকে টিভির দর্শক পর্যন্ত মোট পাঁচ ধাপের স্তরে চতুর্থ ধাপে বিভিন্ন পাড়ার অগুনতি অপারেটর। তাদের অধীনে রয়েছেন লাইনম্যানরা। তাঁরা বাড়ি বাড়িতে কতগুলি সংযোগ পৌঁছে দেন, সেই হিসেবটাই দিতে চান না। ফলে সংযোগের সংখ্যা মারাত্মক কম দেখিয়ে এমএসও থেকে সরকার পর্যন্ত সর্বত্র বৈধ কর দেন না অপারেটররা। ডিজিটাল সেট-টপ বক্স বসে গেলে যেমন এক লহমায় দিল্লি পর্যন্ত সংযোগের হিসেব জানতে পারবে, তেমনই অপারেটরদের থেকে রাজস্বও আদায় হবে। অথচ এই বিষয়টিই রাজ্য কেন বুঝতে চাইছে না, এ দিন বৈঠকে সেই প্রশ্নও তোলেন এমএসও সংস্থাগুলির কেউ কেউ।
অপারেটরদের একটি সংগঠন কয়েক মাস আগে নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে জানায়, কলকাতা মেট্রো এলাকায় ৪২ লক্ষের মতো টেলিভিশনে কেব্ল সংযোগ আছে। এর অর্ধেকে ডিজিটাল সেট-টপ বক্স লাগানো হয়েছে। বাকি অংশে লাগানো হয়নি, তার কারণ বাক্সের অভাব। কিন্তু এ দিনের বৈঠকে চার বড় এমএসও সংস্থার কেউই বাক্সের অভাবের কথা স্বীকার করেননি। কলকাতা কেব্ল অ্যান্ড ব্রডব্যান্ড পরিষেবা লিমিটেড সংস্থার ডিরেক্টর বিজয় অগ্রবাল জানান, তাঁর নিজেরই একটি সংস্থা আছে চিনের সেনজুয়ানে। সেখান থেকে আমদানি করা যন্ত্র তাঁর উল্টোডাঙার গুদামে ডাঁই হয়ে রয়েছে। চারটি কন্টেনার-ভর্তি আরও যন্ত্র আটকে রয়েছে বিমানবন্দরের কাছে আর একটি গুদামে। একই ভাবে সিটি কেব্ল, মন্থন সংস্থার গুদামেও যন্ত্র পড়ে রয়েছে। এ দিন মন্থনের ডিরেক্টর সুদীপ ঘোষ বলেন, “আমরা কেন্দ্রীয় আইন মেনে ডিজিটাইজেশনের কাজ করছি, সে কথাই চিঠিতে লেখা হয়েছে।” সিটি কেব্লের এমডি সুরেশ শেঠিয়া বলেন, “আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রাজ্য সরকারের উদ্বেগ অমূলক নয়। কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক এবং রাজ্য সরকার আমাদের অনুরোধ করেছে, দরিদ্রদের এলাকায় আরও কম টাকায় বক্স দেওয়া যায় কি না। আমরা শীঘ্র সেটাই করতে চলেছি।” |