দুর্গাপুজোরও আগে থেকে শুরু হয়ে যায় যে দিনটির প্রতীক্ষা, তার কাউন্ট ডাউন শুরু। বাঙালির অন্য সব আবেগ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে কৃষ্ণনগর, শুধু এই দিনটিরই জন্য। শহরে এ বার ১২১টি পুজো অনুমতি পেয়েছে। অনুমোদনহীন এবং বাড়ির পুজো মিলিয়ে রয়েছে আরও অন্তত ৪০টি পুজো। সেই সঙ্গে এই শহর ভরে থাকবে সারা রাজ্য থেকে আসা বহু পর্যটকে। |
উৎসবের সময়ে প্রধান উৎপাত ইভ-টিজিং। এই শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই সরু সরু। রাতে পুজো দেখতে বার হন অসংখ্য মানুষ। তাতে অনেকেই থাকেন শহরের বাইরের। কেউ ফূর্তি করতে আসেন। কেউ আসেন পুণ্য করতে। এই সময়ে এখানে ইভ টিজিংয়ের উৎপাত নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই পুলিশ তিতিবিরক্ত। শুধু তাই নয়, মহিলা ছিনতাইকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। পুজো দেখার ভিড়ে পাশের সুন্দরী মহিলাটিই যে নিমেষে গলার হারটি ছিনতাই করে পলক ফেলার মধ্যেই ভিড়েই মিশে উধাও হয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ বহু বার মিলেছে। বুড়ি মা পুজোর সামনে মহিলা ছিনতাইকারীদের উৎপাত সব থেকে বেশি। ঘট ও প্রতিমা বিসর্জনের দিনেও ইভটিজিং এবং ছিনতাইয়ের উৎপাত সহ্য করতে হয় পর্যটক ও শহরের মানুষদের।
তাই এ বার পুলিশই আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে। সাদা পোশাকের পুলিশ থাকবেন বিভিন্ন মণ্ডপের সামনে এবং রাস্তায়। তাঁদের মধ্যে থাকবেন মহিলারাও। কোনও মহিলাকে কেউ ইভটিজিং করতে চাইলে, হাতেনাতে ধরে ফেলা যাবে তাকে। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইতিমধ্যেই কলকাতা ও তার আশেপাশে দুর্গা পুজো ও কালীপুজোয় এই পদ্ধতিতে সুফলই পাওয়া গিয়েছে। একা দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মহিলাকে দেখে ইভটিজিয করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে অনেক ‘রোমিও’। সে খবর ছড়িয়েও পড়েছে দ্রুত। ফলে অন্যত্রও কমেছে মহিলাদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা। একই ভাবে মহিলা ছিনতাইকারীদেরও গ্রেফতার করা গিয়েছে। মহিলা পুলিশের সেই সাহায্য এ বার কৃষ্ণনগরেও নেওয়া হবে। দুই প্লাটুন মহিলা পুলিশকর্মী তাই আসছেন এই শহরে। তবে সেই সঙ্গেই থাকবে দুই কোম্পানি পুলিশ বাহিনী, ৩ প্লাটুন জেলার পুলিশকর্মী, দুই প্লাটুন র্যাফ। থাকবেন ১০ জন ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার। ১৭ জন ইন্সপেক্টর। শহরের ১০টি জায়গায় বসানো হবে সিসিটিভির ক্যামেরা। ১০টি পুলিশ সহযোগিতা কেন্দ্র থাকবে। এ বারই প্রথম রাখা হচ্ছে জলকামানও। |
পুলিশ-প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, ২৪ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিতেই হবে। ২১ নভেম্বর থেকেই শহরের রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। বাইরের দর্শনার্থীদের শহরে প্রবেশ শুরু হয়ে যায় সেই দিন সকাল থেকেই। তাই ওই দিন থেকেই যান নিয়ন্ত্রণও শুরু করে দেবে প্রশাসন। সে দিন দুপুর ৩টে থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বাস, লরি বা কোনও বড় গাড়ি শহরের রাস্তায় ঢুকতে পারবে না। গাবতলা, ঘূর্ণি, কলতলা, পালপাড়া ও সন্ধ্যা মাঠপাড়ায় বিভিন্ন রুটের বাস দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। ২২ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত আবার শহরে যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। |
শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ইতিমধ্যেই সংস্কার করা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তাগুলিতে অতিরিক্ত আলোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২১ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিবার আধ ঘণ্টা করে বেশি জল সরবরাহ করা হবে। মণ্ডপগুলোর রাস্তার ধারের খোলা নর্দমাগুলি আপাতত কাঠ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে ১০টি পানীয় জলের গাড়ি রাখা থাকবে। থাকবে চিকিৎসকদের দলও। বিসর্জনের ঘাটে থাকবে বাড়তি সাফাই কর্মী। দু’টি নৌকা। থাকবে বিদ্যুৎচালিত করাতও। বিসর্জনের জন্য এ বার ৩২ ফুটের বদলে ৭০ ফুট এলাকা স্থির করা হয়েছে। |
শহরে থাকার জায়গা এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম। উৎসবের দিনগুলিতে তাই সমস্যা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। শহরে মাত্র ৩০টি হোটেল। তাতে খুব বেশি হলে দেড় হাজার মানুষের থাকার বন্দোবস্ত হতে পারে। হোটেল মালিকেরাই বলছেন, পুরো চাহিদার যা মাত্রই ২০ শতাংশ। তাই বাকি বিশাল সংখ্যক মানুষের থাকার ব্যবস্থা কী করে করা হবে? প্রশাসন ও পুজোর উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ঠাকুর দেখতে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে বহু মানুষই কোথাও রাতে থাকেন না। তাঁরা সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটান। ভোরে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যান। কেউ বা কৃষ্ণনগর স্টেশনেই রাত কাটান। এ বারেও পরিস্থিতির বড় কোনও পরিবর্তন হবে না। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, সর্বত্র কড়া নজর থাকবে।
|
কৃষ্ণনগর শহরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় থিমের প্রচলন খুব বেশিদিনের নয়। শহরের এক প্রান্তে ঘূর্ণি এলাকায় মূলত থিমের পুজো হয়। এখানকার পৃথিবী বিখ্যাত মৃৎশিল্পীরা তাঁদের সূক্ষ্ম কাজ আর শিল্প চেতনা দিয়ে গড়ে তোলেন বৈচিত্রপূর্ণ থিমের কাজ। যা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান দর্শনার্থীরা। এ বারও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না। বিশেষ করে ঘূর্ণি শিবতলা বারোয়ারি মাটির মডেল দিয়ে তৈরি হয়েছে ডেঙ্গি প্রতিরোধ অভিযান। ঘূর্ণি দাসপাড়ায় বাংলার আলপনা শিল্প এ বারও দর্শকদের মুগ্ধ করবে। এ ছাড়াও অন্যত্র মণ্ডপ, প্রতিমা, প্রতিমার সাজে ও আলোকসজ্জায় উৎকর্ষের লড়াই হবে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার মধ্যে। |