দুর্গা-কালীর পর এখন প্যান্ডেলে জগদ্ধাত্রী। তার পরও আলো নিভবে না,
মাইক নামবে না। চির-উৎসবের ঠিকানা চেনাচ্ছেন
চিরশ্রী মজুমদার |
খালি চোখে এই রাস্তার কোনও গ্ল্যামার খুঁজে পাবেন না। দু’চার পা অন্তর হেরিটেজ দেখতে বাড়ি আছে, পিরিয়ড ফিল্মের শুটিং হয় দিবারাত্র। বাকিটা উত্তর কলকাতা বলতে ঠিক যেটা ভাবেন। গায়ে পড়া, ইট-পাথর সবুজ জানলা বাড়ি। আজও কেউ হাল ফ্যাশনে সেজে হেঁটে গেলে এ পাড়ার গালে হাত, বিস্ফারিত নয়ন। তা হলে, রামকৃষ্ণ-সারদার পদধূলিবিজড়িত, কবি-সাহিত্যিকের স্মৃতিধন্য হে বাগবাজার ২০১২-র পড়ন্ত বেলায় তোমার হাতে রইল কী?
বলছি। তার আগে কলকাতাটা এক চক্কর মেরে আসুন। উৎসবের মরসুম শেষ। শহরের শরীর-মনে এখনও প্যান্ডেলের দগদগে গর্ত। মিইয়ে গেলেন তো? চিয়ার আপ। এ বার চলুন বাগবাজার। ব্যস্, যাবতীয় মন-খারাপ ছুমন্তরছুঃ।
কারণ, আসিতেছে জগদ্ধাত্রী পুজো! না না, চন্দননগরের বাগবাজার নয়, বলছি খাস কলকাতা-উত্তরের বাগবাজারের কথাই। এই মুহূতের্, ৬১এ বাগবাজার স্ট্রিটে, আবার একটা সুবিশাল প্যান্ডেল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, পর্দা ঢেকে শেষবেলার গয়নাগাটি পরছেন তিনতলা প্রতিমা। বাইরে বিস্তর ব্যস্ততা, মাইক-আলোর লাস্ট মিনিট চেক চেক, পুজো নির্ঘণ্টটা টাঙিয়ে দে। আজই তো ওপেনিং! |
বিসর্জন হইয়াও হইল না শেষ... |
পরশু, যখন কলকাতার উইক-ডে, স্কুল-কলেজ-অফিস, সন্ধ্যায় টিউশন-টিভি-ঘুম, এখানে তখন সকাল থেকে বাজবে মাইক, ঢাক, কাঁসর। আবার এক অপরূপা মৃন্ময়ী দীপের আলোয় ধূপের ধোঁয়ায় আর মন্ত্রপাঠের মায়ায় চিন্ময়ী হয়ে উঠবেন। পুজোর উপচার আর পুষ্পাঞ্জলি জড়ো হবে তাঁর পায়ের কাছটিতে। আয়তনেত্রে প্রাণ ফুটবে, মুখে ঘামতেল গড়াবে, সোনালি প্রদীপে জ্বলে উঠবে অগুন্তি আগুনশিখা। সন্ধ্যা নামবে, সঙ্গে প্রথম শীতের ছোঁয়াচ, মধ্য হেমন্তেও অনন্ত শরৎ এসে দখল নেবে এই পাড়ার। চার দিকে রঙিন আলোর মালা পরে জ্বলে উঠবে ব্যানার বিজ্ঞাপনে সুসজ্জিত বাড়িগুলো, উঠোনে উঠোনে ভোগ রান্নার তৎপরতা, আবার রাস্তা জুড়ে সুখাদ্যের স্টল, আনন্দের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা। মাঠে নাগরদোলার ঘুরপাক, লাইটিংয়ে ক্যান্সারজয়ী যুবরাজ, রাস্তায় সকলে আবার চকমক সেজে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। ভিড় সামলাতে দড়ি, প্রসাদের জন্য অপেক্ষমাণ জনতার লাইন গিয়েছে বহু দূর। উঁচু বাড়ির মাথায় উঠলে, কথা হারিয়ে যায়। বাকি শহর কুয়াশা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর এই অংশ আলোয় উজ্জ্বল, ঘোর জীবন্ত। যে দিকে তাকাও মানুষের মাথা আর প্যান্ডেলের চূড়া!
গ্যারান্টি, এলেই দুর্গাপুজো ভাববেন! প্যান্ডেলে ঢুকে চোখ কচলে হাতি, সিংহ, চতুর্ভুজা দেবীকে না দেখলে তফাত নেই। সেই পুষ্পাঞ্জলি, ম্যারাপ বেঁধে জলসা, মাইকে ‘আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে’ ঘোষণা। শেষ দিন ফের সিঁদুর খেলা, ঠাকুরকে মিষ্টিমুখ-প্রণাম। গেট, ঘোড়ার গাড়ি, বিসর্জনের প্রসেশন। শুধু বাগবাজার সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজোই নয়, আশপাশে অন্তত খান তিরিশ পুজো হয়। ফলে, দশমীর রিপিট টেলিকাস্ট। রাস্তা জুড়ে এ ক্লাব ও ক্লাবের ঠাকুর চলেছেন, তাসা ও ছোড়া গঙ্গাকিনারেওয়ালা বাজাচ্ছে, গাছের ডালে মায়ের মুকুট আটকে গেছে!
তার পর ঢাকের তালে সেই লাস্ট সিন আবার ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ... হাঁফ ছাড়লেন? ভাবছেন, যাক, এ বার এ বছরের মতো শেষ হল? মিসটেক, মিসটেক! আমি জানি, আর এ পাড়ার প্রত্যেকে জানে, এই সপ্তাহের শেষে জগদ্ধাত্রীর বিসর্জন হবে, কিন্তু উৎসবের দি এন্ড হবে না মোটেও। আমাদের পাড়ায় একটা উৎসব শেষ হলেই তৎক্ষণাৎ অন্যটার প্রস্তুতি শুরু। জাস্ট ক’দিন জিরিয়েই, ডিসেম্বরের শেষটায় পৌষকালী পুজো। তাতেও গেট, আলো, মেলা, অনুষ্ঠান। তার পরই ৩১ তারিখ পৌনে বারোটা থেকে ব্যান্ডপার্টির প্যারেড, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নিউ ইয়র্ক কায়দায় আকাশে হাউই উঠবে। বছর শেষ।
এবং নতুন বছর শুরু, আবার নতুন ফেস্টিভাল। সারা বছর। যে কোনও দুটো উৎসবের ফাঁকে একটা উৎসব। ক্যালেন্ডারে কিছু নেই তো, রবিবার আছে। অতএব রক্তদান ক্যাম্প, সন্ধেতে টলি-বলির গাইয়ে ডেকে জলসা। নয়তো বাগবাজার উৎসব, নিদেনপক্ষে গাছ-প্রদর্শনী, পঁচিশে বৈশাখ, নাট্যোৎসব, মহারাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছোড়া গণেশ পুজো। তাই এ পাড়ার গা থেকে লাইট মাইক খোলার দরকারই নেই। মেগাপ্রশ্নটা হচ্ছে, সারা ক্ষণ এমন দল বেঁধে মৌজমস্তির সময় মেলে কোত্থেকে? কী আছে এই প্রাচীন সুতানুটির? চিরনবীন প্রাণশক্তি? ধুর, ও সব সাধুভাষায় বললে কিচ্ছুটি বোঝা যায় না, এ-মিস্ট্রি বুঝতে কমার্শিয়াল হিন্দি সিনেমার ভোকাবুলারির আশ্রয় নিতে হয়। জান, জান। ওইটির জোরে বাঙালির চিরকালীন সুখস্বপ্নটিকে আমাদের পাড়াটি রিয়েলিটি বানিয়ে ছেড়েছে। শারদোৎসব-কালীপুজো-ভাইফোঁঁটা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে সবাই যখন পুজোটা আসে তো যায় কেন, এই ডিপ্রেশনে দোর দিয়ে ফেলছে, তখন এখানে আবার পুজো কামিং!
ওইখানেই জয় বাবা জীবনীশক্তির জয়। সেই জাঁহাবাজ জান। তার তাগদেই, প্রেশারকুকার পৃথিবীতে নির্মল আনন্দের খাতিরে, হাজার কাজ মিটিয়ে সুখী অবসরটাকে কেড়ে আনা যায়। টেকনিকটা জানা তাই প্রচণ্ড উদ্যমে তারা আনন্দের বাজনা বাজিয়েই চলে। অ্যাত্তো স্পিরিট, ইতনা এনার্জি! আমিও আদ্ধেক সময় তাল রাখতে পারি না। কিন্তু মনের এক কুঠুরিতে সে সারাক্ষণ ডিস্কো লাইট জ্বালিয়ে রাখে। যে ঘুমপাড়ানি সন্ধেয় কিচ্ছুটি করার নেই, সে দিনও বুক ঠুকে হুহুংকার, ‘পাড়ায় চলে আয়। রিপাবলিক ডে হচ্ছে!’ আবার এক দিন জরাজীর্ণ প্রথম শীতের দুখিনি রাত, আর আমার বাড়ি পৌঁছে যায় কার্তিক পুজোর প্রসাদ! হাসতে হাসতে হঠাৎ চুপ হয়ে যাই।
রাংতা-দুনিয়ায় থাকি আমরা! প্রতিদিনান্তে এখানে ফিরলেই গান বাজে, আলো জ্বলে, বাজির গন্ধ ওড়ে। অমনি পৃথিবীর দেওয়া ক্লেদ ভুলে বুঁদ হয়ে ঘুরি। যেন, মায়াপুরী, যেখানে ৩৬৫ দিনই পুজো স্ট্যাচু হয়ে আছে। এক রাশ ভাল লাগা কুড়িয়ে তৃপ্তির ঘুম এসে যায় রাতে। কিন্তু তখনও পাড়াটার অষ্টমীর বিকেল সাজার সাধ মেটে না। তাই বন্ধ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন আর ডি-আশা ভোঁসলেরা। ফিরে এলাম...আমি তোমার...
উৎসব চলতেই থাকে। আমাদের পাড়া বাঁচতেই থাকে। যব তক হ্যায় জান। |