দল নয়, ধর্ম নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, দাদা নয়, দিদি নয়, আশ্রয় খুঁজতে হয় ব্যক্তিমানুষের কাছে।
খুঁজলে, আশ্রয় মেলে। আজও। এই ক্লেদাক্ত, হিংস্র, তরজামুখর পশ্চিমবঙ্গেও।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলে এখন খুব সুবিধে হত। ডাইনে বাঁয়ে অন্ধকারে ঢাকা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ তাঁর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত, এমনকী তিনি যা করেন সবই মঙ্গলের জন্যে ভেবে নিয়ে সুখে থাকাও অসম্ভব হত না। কিন্তু এ-যাত্রা সেই সুখ বোধ করি অধরাই রয়ে গেল। তা হলে উপায়? রোজ দুবেলা কর্দমাক্ত সওয়াল-জবাবের লাগাতার সম্প্রচার শুনতে শুনতে আর পারস্পরিক খুন-জখমের হিংস্রতা দেখতে দেখতে শ্মশানযাত্রীর চেনা কথা চেনা সুর ভাঁজব, তা-ই বা প্রাণ থাকতে মেনে নিই কী করে? অতলান্ত শুভনাস্তিকতায় তলিয়ে যেতে যেতে তাই শেষ পর্যন্ত আশ্রয় খুঁজতে হয় দল নয়, ধর্ম নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, দাদা নয়, দিদি নয় ব্যক্তিমানুষের কাছে। খুঁজলে, আশ্রয় মেলে। আজও।
বেশ কিছু দিন আগে হাতে এসেছিল একটি রিপোর্ট: কলমচারি। রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার বিবরণ। গত বছর মার্চ থেকে জুলাই মাসে দশটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিলেন প্রতীচী ইনস্টিটিউট। পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলার প্রায় সাড়ে তিনশো শিক্ষক এবং কয়েক জন শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের সহায়িকা ও সমাজকর্মী যোগ দেন কর্মশালায়। তাঁদের বলা হয়েছিল নিজের নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে। নির্বাচিত কিছু লেখা রিপোর্টটিতে রেখেছেন প্রতীচী, সঙ্গে আছে তাঁদের নিজেদের বিশ্লেষণ। রিপোর্টটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কিছু আলোচনা হয়েছে, যদিও এ ধরনের উদ্যোগ সম্পর্কে যতটা সামাজিক কথোপকথন হওয়া জরুরি, তার এক আনাও আমাদের এ-দিকে হয় না, ও-সব আমাদের ধাতে নেই, আমরা তরজা ভালবাসি, শিক্ষকদের সাদামাটা অভিজ্ঞতা নিয়ে তরজা লড়া কঠিন। |
তবু মায়া, তবু আত্মমর্যাদা। এই ছবি পশ্চিমবঙ্গের। |
সাদামাটা বলেই বেশ লেগেছিল কুমার রাণা সম্পাদিত সঙ্কলনটি। অনেক দিন পরে নতুন করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার যেন একটা স্বস্তি পেলাম। পাতায় পাতায় খুব ঘরোয়া, আন্তরিক একটা সুর। যেমন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের এক শিক্ষিকা লিখেছেন, “১৯৭৬ সালে আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করি। বাবা আমাকে কলেজে পড়াতে পারেননি। তারপর বিয়ে দেন। তখন থেকে আমি গৃহবধূ; বাড়ির কাজে লিপ্ত ছিলাম, ২০০০ সালে এই শিশু শিক্ষা কেন্দ্র-এ শিক্ষার কাজে ব্রতী হলাম। এখন ঘরে যত কাজ থাক, স্কুলে না গেলে প্রাণটা ভীষণ কষ্ট পায়। সংসারের সমস্ত কাজকর্ম সেরে ১০টা বাজলে বিদ্যালয়ের দিকে ছুটি কতক্ষণে শিশুদের দেখবো।’’
এতই সহজ, স্বাভাবিক এই কাহিনি যে, মনে হতেই পারে, এ আর লেখার কী আছে? কিন্তু লেখাটি পড়ে দু’দণ্ড চুপ করে চোখ বুজে বসে থাকলে পাড়াগাঁয়ের একটা ছোট্ট গরিব পাঠশালা দিব্যি দেখা যায়, এক ঘর ছোট ছোট পড়ুয়া দিদিমণিকে ঘিরে বসে পড়ছে, নামতা বলছে, হইচই করছে, গল্প শুনছে, যে গল্প তারা বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে শোনাবে। এই দৃশ্যে যে বস্তুটি নিহিত আছে, তার নাম মায়া। সহজ, স্বাভাবিক মানুষী মায়া। ‘কলমচারি’র আনাচেকানাচে এই মায়ার অজস্র ছবি। জলপাইগুড়ি জেলার এক শিক্ষিকা আগে ডুয়ার্সের একটি প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেন। এক দিন খুব বৃষ্টি। সম্পূর্ণ ভিজে স্কুলে পৌঁছেছেন। ক্লাসে গিয়েছেন। ক্লাস টু। হঠাৎ একটি ছেলে ভয়ানক বায়না ধরল, বাড়ি যাবে, তক্ষুনি। কিন্তু কেন? কিছুতেই বলবে না সে। শেষে, অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরে জানা গেল, ‘লুগা লিয়ানু’। মানে ‘কাপড় আনব’। দিদিমণির জন্যে বাড়ি থেকে শুকনো কাপড় নিয়ে আসবে ও। কে বলেছে, স্নেহ কেবল নিম্নগামী?
স্নেহ-মায়া প্রায়শই অন্তঃসলিলা, হঠাৎ কখন অর্জুনের তিরে দীর্ণ ভূমি থেকে নিঃসৃত জলধারার মতো সে-অনুভূতি ভেসে উঠবে, কেউ জানে না। জলপাইগুড়িরই আর এক স্কুলের শিক্ষকের কাহিনি। তাঁর ক্লাসে একটি ছেলে পড়ে, তার নাম ভীম। ‘‘দেহে নয়, বুদ্ধিতে নামের প্রতি সে সুবিচার করেছে একথা মনে হত প্রায়শই।” এক দিন ঘুরতে ঘুরতে না জেনেই তার বাড়িতে হাজির মাস্টারমশাই। কাঠফাটা দুপুর। ভীমের মা মাঠে কাজ করছিলেন। ছুটে এসে ঘর থেকে মোড়া আনলেন, হাতপাখা। চকচকে পেতলের থালায় চিড়ে ও বাতাসা এল। কাচের গ্লাসে টলটলে জল। উঠে আসার সময় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বললেন, মাস্টারমশাই, ছেলেটাকে একটু মানুষ করি দিবেন। মাস্টারমশাই লিখছেন, “সেদিন কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছি। যদি জানতাম কীভাবে মানুষ করে দেওয়া যায়...”
ভীম এগিয়ে যেতে পেরেছিল কি না, তার শিক্ষক তাঁর লেখায় সে কথা জানাননি। নাসিমা পেরেছিল। মালদহের এক মাস্টারমশাই লিখেছেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী নাসিমা খাতুনের কথা। রিডিং পড়তে পারে না। কথা বলে বুঝলেন, বর্ণপরিচয়ও হয়নি। পরের তিন দিন অক্ষর চেনানোর ব্যর্থ চেষ্টার পরে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘স্কুলে আসছো কেন? বাড়ির কাজ করলে অনেক লাভ হবে।’’ বলেই বুঝতে পারলেন, অন্যায় করেছেন। ক্লাসেরই দুটি মেয়েকে নাসিমার বর্ণপরিচয়ের দায়িত্ব দিলেন। পর দিন অ আ ই ঈ লিখতে পারল সে। মাস্টারমশাই বললেন, “বাঃ। এই তো পারলে। সুন্দর হয়েছে। তুমি তো পারবে। ভয় করছ কেন?’’ সঙ্গে সঙ্গে ‘তার ভীত-লাজুক কালো মুখমণ্ডলটি উজ্জ্বল হয়ে গেল। চলাফেরা চনমনে হয়ে গেল।’ এবং, ‘অত্যন্ত সন্তোষজনক ভাবে চতুর্থ শ্রেণির পড়া শেষ করল’ নাসিমা।
এক একটি লেখায় এক এক রকমের কাহিনি। কিন্তু একটা যোগসূত্র সহজেই মিলে যায়। তার নাম পরিবর্তন। শব্দটির ওপর ইদানীং আমরা বহু অত্যাচার করেছি, এখনও করছি, কিন্তু আমাদের পল্লিসমাজের তরজায় সত্যিকারের পরিবর্তনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার নয়। অকপটে লিখেছেন উত্তর দিনাজপুরের এক শিক্ষক, প্রথম যে দিন চাকরি করতে গেলেন, স্কুলবাড়িটার হাল দেখে কাঁদতে বসেছিলেন। ‘তিন মাস পরে প্রধান শিক্ষক retire করে গেলেন। আমি একা... মনে মনে ঠিক করলাম যেমন করেই হোক কিছু একটা করে দেখাবো’। গ্রামের স্কুলে পড়াতে গিয়ে শহর বা মফস্সলের মানুষের প্রথমটায় খুব দমে যাওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক, কিন্তু তার পর অনেকেই দ্রুত আলোর পথযাত্রী হয়ে ওঠেন। কোথা থেকে আসে সে আলো? মায়া? নিশ্চয়ই। কিন্তু তার সঙ্গে থাকে আত্মসম্মানের বোধ। যে দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, সেটি ঠিক ভাবে পালন করা আমার কর্তব্য: এটাই আত্মসম্মানের অন্তর্নিহিত উচ্চারণ। যাঁরা নিজের অন্তরে সে উচ্চারণ শুনতে পান, তাঁদের গুরুত্ব সংখ্যায় মাপা যায় না। দারিদ্র, অপুষ্টি, দূরত্ব, পরিকাঠামোর ভয়াবহ অভাব, এ সব নিয়েই তাঁরা তাঁদের লড়াই চালিয়ে যান।
সেই লড়াইয়ে তাঁদের সবচেয়ে বড় সহায় হয়ে ওঠে ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, আর তাদের অভিভাবকরা। অনেকেই লিখেছেন, প্রথম প্রথম বেশির ভাগ পড়ুয়া স্কুলে আসত না। শিক্ষক তাদের বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, তাঁদের স্কুলে মাঝে মাঝে মিটিংয়ে আমন্ত্রণ জানালেন, দেখতে দেখতে ছবিটা পালটে গেল, বিশেষ করে মায়েরা খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন, ক্লাসঘর ভরে উঠল। এবং এর মধ্যে দিয়েই কখন স্কুল আর বাড়ির মাঝখানের বেড়াটা ভেঙে পড়ল, শিক্ষক হয়ে উঠলেন বাড়ির মানুষ। উত্তর দিনাজপুরের এক শিক্ষক লিখেছেন, প্রথম তিন মাস বাড়ি বাড়ি যেতেন তিনি, কেবল ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে বলতেন না, ছোটখাটো সমস্যার সুরাহা করতেন, হাসপাতালে, থানায় দৌড়তেন। তার পর এক দিন দেখলেন, তিনি রাস্তায় বেরোলেই অভিভাবকরা বাড়ির শিশুদের ডেকে বলছেন, ‘লয়া মাস্টারখান যাচ্ছে, যা যা তাড়াতাড়ি ইস্কুল যা।’ চাকরি, দায়িত্ব, সহমর্মিতা, ক্লাস, পরিবার, সব একাকার হয়ে গেল। গড়ে উঠল এক গভীর সামাজিকতা। তার প্রতিফলন ঘটল ক্লাসঘরেও। দক্ষিণ দিনাজপুরের এক শিক্ষক লিখেছেন, প্রথমে যখন চেয়ার-টেবিলে বসে পড়াতেন, ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে দূরেই রাখত। এক দিন নেমে এলেন মাটিতে, বসলেন ওদের সঙ্গে, ওরাও অনেক সহজ হয়ে গেল।
রূপকথা? হয়তো। প্রদীপের নীচে হয়তো বিস্তর অন্ধকার। কিন্তু তাতে প্রদীপের শিখাটুকু মিথ্যে হয়ে যায় না। আপাতত ওইটুকুই ভরসা। ওইটুকুই বিশ্বাস। আর, বিশ্বাস না করেই বা গতি কী? ঈশ্বর জবাব দিয়েছেন, মানুষ ছাড়া তো বিশ্বাসের আর কোনও সম্বল নেই। |