পথ আছে, পারানি নেই। তাই রাজস্বও নেই।
যেমন তেমন পথ নয়। কলকাতা থেকে দিল্লি চলে যাওয়া ২ নম্বর জাতীয় সড়কের মধ্যেই ঝাঁ চকচকে ৬৫ কিলোমিটার। হুগলির ডানকুনি থেকে বর্ধমানের পালশিট পর্যন্ত চার লেনের যে রাস্তার নাম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। দুই প্রান্তে, ডানকুনি ও পালশিট টোল প্লাজায় কর নেওয়া বন্ধ এক মাসেরও বেশি। ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কলকাতা থেকে রাজ্যের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর-আসানসোল হয়ে বরাকরের দিকে চলে যাওয়া এই রাস্তা দিয়ে প্রতি দিন অজস্র গাড়ি, বাস, ট্রাক চলে। কিন্তু গত ৮ অক্টোবর থেকে দুই প্লাজাতেই কর নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই) এবং রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের নেতারা একে অপরকে দুষছেন। আশু সমাধানের সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। দুই টোলপ্লাজার প্রায় সাড়ে তিনশো কর্মীরও অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে।
সমস্যার সূত্রপাত এনএইচএআই কর আদায়ের ঠিকাদার বদল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই। সংস্থার সিজিএম (পূর্বাঞ্চল) অজয় অহলুওয়ালিয়া জানান, আগে একটি সংস্থাকে বেছে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দরপত্রের মাধ্যমে জাতীয় স্তরের এক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে কর্মীরা দুই প্লাজায় এত দিন কাজ করতেন, তাঁরা বেঁকে বসেছেন। তাঁদের দাবি, কোনও কর্মীকে ছাঁটাই করা যাবে না। সবাইকে একই বেতনে বহাল রাখতে হবে। নতুন ঠিকাদার তাতে রাজি নয়। |
দুই টোল প্লাজাতেই কর্মী সংগঠন তৃণমূল প্রভাবিত আইএনটিটিইউসি-র হাতে। নতুন সংস্থাকে তারা টোলপ্লাজায় ঢুকতেই দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। রাজ্যের আইনমন্ত্রী তথা পালশিট টোল প্লাজার সংগঠনের নেতা মলয় ঘটক দাবি করেন, “এনএইচএআই-এর খামখেয়ালের কারণেই কর আদায় বন্ধ রয়েছে।” গত ১৪ অক্টোবর মহাকরণে এনএইচএআই প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি দুই টোল প্লাজার শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল এবং বকেয়া মেটানোর দাবি জানান। কিন্তু সেই জট এখনও খোলেনি। সিজিএম (পূর্বাঞ্চল) বলেন, “যে সংস্থা দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দর দিয়ে বরাত পেয়েছে, তারা তো লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতেই পারে। অকারণ
বাড়তি খরচের বোঝা তারা বইতে চাইছে না।”
মলয়বাবুর অভিযোগ, “দুই প্লাজায় প্রতি দিন গড়ে যথাক্রমে ২৩ ও ২০ লক্ষ টাকার কর আদায় হত। তা বন্ধ থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, রাজ্য সরকারও করের প্রাপ্য অংশ পাচ্ছে না।” ডানকুনি টোল প্লাজার শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি সুবীর মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “শ্রমিকদের বেতন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতি দিন ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে রাজ্য সরকার।”
দুই টোল প্লাজার ওই কর্মীদের বিরুদ্ধে অবশ্য আগে নানা অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে আদায় হওয়া কর ঠিক মতো জমা না পড়া থেকে যাত্রীদের হেনস্থা এমনকী মারধরের অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু তা বলে কর্মী পরিবর্তনের কথা নেতারা শুনতে রাজি নন। মলয়বাবুর বক্তব্য, “আগেও বেশ কয়েক বার ঠিকাদার বদল হয়েছে। তারা আগের সংস্থায় নিযুক্ত কর্মীদের ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। দু’টি প্লাজায় আমাদের সমর্থকেরা লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন। এনএইচএআই যদি
ভেবে থাকে কয়েক মাস টোল আদায় বন্ধ রেখে নতুন সংস্থাকে বরাত দেবে, ভুল ভাবছে।”
এনএইচএআই অবশ্য বলছে, আপাতত দুই প্লাজা মিলিয়ে রোজ গড়ে ২০ লক্ষ টাকা কর আদায় বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী লাভের কথা মাথায় রেখেই এই লোকসান মেনে নিতে হচ্ছে। সংস্থার সিজিএম (পূর্বাঞ্চল) বলেন, “আদায় হওয়া করের ভাগ বাবদ আমরা নতুন সংস্থার কাছ থেকে আগের চেয়ে রোজ প্রায় চার লক্ষ টাকা বেশি পাব। ফের কর আদায় শুরু হতে আরও মাস দুই-তিন লাগবে। কিন্তু তাতে আখেরে লাভ হবে।” প্রকল্প আধিকারিক (দুর্গাপুর) কৃষ্ণ মুরারীও বলেন, “আরও কিছুটা সময় লাগবে।”
কিন্তু আইনশৃঙ্খলার সমস্যাও যে হচ্ছে! এক্সপ্রেসওয়ের দেখভালে জড়িত একটি বেসরকারি সংস্থার আধিকারিক ইন্দ্রজিৎ ভাদুড়ির কথায়, “এই রাস্তায় প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানো যায়। কেউ না থাকায় সুশৃঙ্খল ভাবে প্লাজা পার হওয়ার বদলে গাড়িতে গাড়িতে রেষারেষি চলছে। বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।” এনএইচএআই অবশ্য তার দায় নিতে রাজি নয়। সিজিএম (পূর্বাঞ্চল)-এর মতে, “রাজ্য সরকার যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করত, নতুন সংস্থাকে পুলিশি নিরাপত্তা দিত, তা হলে এই পরিস্থিতি হত না।” |