প্রতি বছর নিয়ম করে আবদুর রাকিব, হাতেমুল ইসলাম, খাইরুল আনাম চৌধুরীরা যেতেন সুজাতা দে বসুর বাড়িতে। ভাইফোঁটার উৎসব সেখানে বাঁধা ছিল।
শুরুটা কিন্তু হয়েছিল সেই ১৯৫০ সালে। বহরমপুর গার্লস কলেজের ছাত্রীরা শিবরাত্রির উপবাস ভঙ্গ করতেন ‘ব্রাহ্মণ’ রেজাউল করিমকে ভোজন করানোর পরেভাইফোঁটা উপলক্ষে ফেলে আসা ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে রেজাউল করিমের ছাত্রী কণা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “১৯৫০ সালে ইন্টার মিডিয়েটে বহরমপুর গার্লস কলেজে ভর্তি হয়ে আমি রেজাউল করিমকে স্যার হিসেবে পেয়েছিলাম। কলেজের মেয়েরা সেই সময়ে শিবরাত্রি উপলক্ষে উপবাস করত এবং পরের দিন ব্রাহ্মণ ভোজনের পরে সেই উপবাস ভঙ্গ হত। সে বার সেই ব্রাহ্মণের খোঁজ করতে তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রীতি গুপ্তা বলেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণ তো আমার কলেজেই রয়েছেন।’ এর পরেই রেজাউল করিমকে ভোজন করানোর পরে মেয়েরা উপবাস ভঙ্গ করেছিল।”
তারপর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে রেজাউল করিমকে শিবরাত্রির পরের দিন ‘ব্রাহ্মণ ভোজন’ করানো হত। ওই রেওয়াজ চালু হয়ে যায় সরস্বতী পুজোতেও। গার্লস কলেজের অর্থনীতির শিক্ষিকা সুজাতাদেবী বলেন, “সরস্বতী পুজোর পরে প্রসাদ বিতরণের পালা। বেশ মনে পড়ছে, প্রথমে যিনি প্রসাদ গ্রহণ করতেন তিনি হলেন রেজাউল করিম।” সুজাতাদেবী বলেন, “আমি ১৯৬৯-৭০ সালে কলেজে পড়াতে শুরু করি। তখন রেজাউল করিম অবসর নিয়েছেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরেও তিনি কলেজে পড়ানোর জন্য আসতেন। তিনি পড়াতে ভীষণ ভালবাসতেন। সেই টানেই যত দিন শারীরিক ভাবে সক্ষম ছিলেন কলেজে এসেছেন।” পরে কলেজ আসা কমে যায়। তবে ২৬ জানুয়ারি এবং ১৫ অগস্ট তাঁকে কলেজে নিয়ে আসা হত।
সেই পথেই সুজাতাদেবীর বাড়িতে ফোঁটা নিতে হাজির হতেন আবদুর রাকিব, হাতেমুল ইসলাম, খাইরুল আনাম চৌধুরীরা। সুজাতাদেবীর কথায়, “ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতেই রাকিবদের ফোঁটা দিতাম। রাকিব যত দিন বেঁচেছিল প্রতি বছর নিয়ম করে ফোঁটা নিতে আসত।” অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক মৃণালকান্তি চক্রবর্তী জানান, ভাইফোঁটা উপলক্ষে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উস্তাদ আবু দাউদ খাঁকে প্রতি বছর নিয়ম করে ভাইফোঁটার দিন ফোঁটা দিতেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী নিবেদিতা ভট্টাচার্য।
সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কেদারেশ্বর চক্রবর্তী বলেন, “আমার ছাত্রী কামান্নাহার, শাবানা, রেহেনা যেমন প্রতি বছর বিজয়ার পরে আমায় প্রণাম করতে আসে। তেমনি আমার মেয়ে সোমদত্তার কাছে উভয় সম্প্রদায়ের ছাত্ররা প্রতি বছর ভাইফোঁটা নেয়। এটাই তো সনাতন ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।”
বহরমপুরের অভিজাত ‘সান্যাল বাড়ির’ নলিনাক্ষ সান্যালের বন্ধু ছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে নজরুল বহরমপুরে আসেন এবং বরযাত্রীও গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য বরযাত্রীদের থেকে দূরত্ব রেখে নজরুল ইসলামকে খেতে দেওয়া হয়। নলিনাক্ষ সান্যালের ভাই শশাঙ্কশেখর সান্যাল ওই দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে দাদাকে বিয়ের মঞ্চে গিয়ে বলে যে, ‘দাদা ওরা কাজিকে অপমান করেছে। এই বিয়ে হবে না, তুই চলে আয়।’ তখন নজরুল বুঝিয়ে শান্ত করেন। এর পরে বিয়ে শেষে ভোরের দিকে উঠোনে চেয়ারে বসে বাড়ির কর্তা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছেন। সেই সময়ে তিনি শুনতে পান সুমধুর কন্ঠে কেউ এক জন শ্যামাসঙ্গীত গাইছে। খড়ম পায়ে উঠে গিয়ে তিনি দেখেন--বাড়ির কালীমন্দিরে বসে চোখ বন্ধ করে নজরুল গাইছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরছে। পর দিন দুপুরে যখন বরযাত্রীদের খেতে দেওয়া হয়, সেখানে অন্যদের সঙ্গে নজরুলেরও খাবার জন্য পাতা দেওয়া হয়েছে। শশাঙ্ক সান্যালের ডান দিকে বসেছিলেন নজরুল। আচমকা শশাঙ্কবাবু বলে ওঠেন‘কাজি এখন খাবে না। পরে খাবে। হারমোনিয়াম নিয়ে এসো। কাজি গান গাইবে।’ নজরুল ইসলাম তখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব/ জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া’, গানটি করেন।
ওই কথা জানিয়ে মৃণালবাবু বলেন, “কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের মা ছিলেন বিন্দুবাসিনীদেবী। তাঁর জন্ম ১৮৮২ সালে। তিনি রক্ষণশীল শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ বিধবা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন তিথিতে বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করে রেজাউল করিমকে খাওয়াতেন। এমনকী খাওয়া শেষে রেজাউল করিমের উচ্ছিষ্ট তুলে ফেলে এঁটো বাসন নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন।”
ভাইফোঁটা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার শহিদ ক্ষুদিরাম পাঠাগারের তরফে যেমন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ফোঁটা দেয়। |