শুকনো মিষ্টি ও সন্দেশের চাহিদাই বেশি
ক কিলো ছানার সঙ্গে দেড়শো গ্রাম গমের আটা মেশাতে হবে। তাতে সামান্য পরিমাণে বড় এলাচ ও ৭০ গ্রাম চিনি মেখে লেচি করতে হবে তারপরে। তবে পেল রসগোল্লার আকার। পরে গরম কড়াইয়ে ঘি ঢেলে ওই রসগোল্লা ভাজা হয়। রসগোল্লার গায়ে কালো রং না আসা পর্যন্ত ভাজা চলতেই থাকে। পরে হালকা চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি হয় ছানাবড়াআর ভাইফোঁটার দিন ওই সাবেকি ছানাবড়ার চাহিদা ছিল বহরমপুরের প্রতিটি মিষ্টির দোকানে।
সেই সঙ্গে রসকদম্ব, ক্ষীরের আপেল, ‘ভাইফোঁটা লেখা’ ক্ষীরের সন্দেশ, নলেন গুড়ের হরেক রকমের সন্দেশ-মণ্ডা-জলভরা তালশাঁস ছাড়াও মিহিদানা, ছানার পোলাও, সীতাভোগ, ছোলার ডালের বোঁদে, ঘিয়ে ভাজা পান্তোয়া এদিন সকাল থেকে দেদার বিকিয়েছে। মোহনের মোড় থেকে নিমতলা যাওয়ার পথে এক নামী মিষ্টির দোকানের মালিক সঞ্জয় সাহা বলেন, “ভাইফোঁটা উপলক্ষে স্পেশাল গোকুল পিঠে তৈরি করেছি। শীতের আমেজ থাকায় নলেন গুড়ের সন্দেশ-মণ্ডার সঙ্গে নলেন গুড়ের জল ভরা তালশাঁসও ভাইফোঁটার দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল। ব্যাপক বিক্রিও হয়েছে।”
খেজুরের গুড় জ্বাল দিয়ে হালকা রস তৈরি করে কড়া পাকের সন্দেশের মধ্যে চালান করে দেওয়া হয়, তাই জলভরা সন্দেশ। সঞ্জয়বাবু বলেন, “সন্দেশে কামড় দিলেই খেজুরের রস জিভ ছুঁয়ে যাবে। জলভরা সন্দেশের সঙ্গে দুধ চমচমের চাহিদা ছিল। ছানার রসগোল্লা তৈরি করে লম্বাটে করে চমচমের আকার দিয়ে তা হালকা রসে চুবিয়ে রাখা হয়। পরে ক্ষীরের রস তৈরি চমচমের উপরে ঢেলে দেওয়া হয়। তাই ক্ষীর চমচম।”
মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কথায়, এখন বাঙালিদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। তাঁদের অপছন্দের তালিকায় থাকছে চিনির ভাগ বেশি রয়েছে এমন মিষ্টি। এজন্য সুগার ফ্রি কালাকাঁদ, চিত্তরঞ্জন থেকে পান্তুয়া ও বিভিন্ন সন্দেশ রাখতে হচ্ছে। এদিন ভাইফোঁটায় তার চাহিদাও ছিল। বহরমপুর কুণ্ডু নার্সিংহোমের মোড়ের এক মিষ্টির দোকান মালিক ভজনচন্দ্র ঘোষ বলেন, “এই সময়ে যে ধরনের সাবেকি মিষ্টির চাহিদা থাকে, তা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। তাই মিহিদানার ও বোঁদের লাড্ডুর পাশাপাশি ঘিয়ের ছানাবড়া, পান্তোয়া, রসগোল্লা তৈরির উপরে জোর দিয়েছি।”
ভাইফোঁটা লেখা ক্ষীরের সন্দেশ প্রতি পিস ৫ টাকা। রসকদম্ব ৫ ও ১০ টাকা। ক্ষীরের আপেল ৫ টাকা পিস বিক্রি হয়েছে। মিহিদানা, ছানার পোলাও সীতভোগ ১৪০ টাকা প্রতি কিলো এবং ১২০ টাকা কিলো দরে ছোলার ডালের বোঁদে বিকিয়েছে। ভজনবাবুর কথায়, “এদিন রসের চেয়ে শুকনো মিষ্টি ও সন্দেশের চাহিদা ছিল বেশি।”
তবে রসমালাই বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা কিলো দরে। পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির মুর্শিদাবাদ শাখার সাধারণ সম্পাদক বিজয়গোপাল সাহা বলেন, “চিনি ৪০ টাকা কিলো, মোয়া ১৭০-১৮০ টাকা কিলো। ছানার দর দেড় গুণ বেড়েছে। ৭০ টাকা কিলো ছানা বর্তমানে ১২০ টাকা দর। ফলে গত বছর পুজোয় ৩ টাকায় সন্দেশ বিক্রি করলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। ওই ৩ টাকার সন্দেশ বেড়ে ৫ টাকা হয়েছে।” তিন টাকা দামের কোনও মিষ্টি বাজারে নেই। ডালডায় ভাজা লাড্ডু ৪ টাকা। ঘিয়ে ভাজা ওই লাড্ডু ৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অতীতে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে অবশ্য বাড়িতে হরেক রকমের মিষ্টি বানানোর চল ছিল। ভাইফোঁটা উপলক্ষে যে জাঁকজমক, অনেক আগে থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন রাজবাড়িতে। ভাইফোঁটা উপলক্ষে সেজে উঠত রাজবাড়িগুলি। আলো দিয়ে সাজানো হত গোটা বাড়ি। অনেক আগে থেকেই রাজবাড়ির ঝাড়লন্ঠন থেকে আলোর বাতি ধোওয়া-মোছার কাজ চলত। বসত মজলিস। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-কুটুম্ব আসত। ভাইফোঁটার দিন নায়েব-গোমস্তাদের ভিড়ে সেরেস্তা গমগম করত। কুয়াশামাখা সকালে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হত।
কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে যেমন ভাইফোঁটা উপলক্ষে হরেক রকমের মিষ্টি বানানো হত। সরভাজা, সরপুরিয়া, চমচম, ক্ষীরের নাড়ু, ক্ষীরের ছাঁচ, রসমালাই, মোহনপুরি, মোতিপাক, ছানাবড়া, চন্দ্রপুলি-সহ আরও নানা রকম মিষ্টি বানানোর জন্য ১০-১২ জন ময়রা সারা দিন ধরে রাজবাড়িতেই পড়ে থাকতেন। কাশিমবাজার রাজবাড়ির পুত্রবধূ সুপ্রিয়া রায় বলেন, “সেই সময়ে ছাঁচে চন্দ্রপুলি তৈরি হত না। দু-হাতে কলা পাতা নিয়ে নারকেল-ক্ষীর-মোয়া দিয়ে মণ্ড তৈরি করে পুলির আকার দেওয়া হত।” এছাড়াও সারা দিন ধরে উনুনে বড় কড়াইতে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির ভিয়েন পাকত। বাড়ির গরুর দুধের ছানা দিয়ে ঘরোয়া চমচম তৈরি হত।
দেবী সিংহের নসিপুর রাজবাড়িতে আবার ৭০-৮০ টি গরু ছিল। ফলে ঘরের দুধ থেকেই ছানা তৈরি করে মিষ্টি তৈরির কাজে লাগানো হত। দেবী সিংহের বংশের ওই রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর সৌরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ বলেন, “আমাদের পরিবারে আমিষ খাবারের রেওয়াজ নেই। ফলে ভাইফোঁটা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি তৈরি হত বাড়িতেই। রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, বোঁদে, ছানার পায়েস তৈরির পাশাপাশি ভাইঁফোটার দিন মিষ্টি পোলাও, লুচি, সাত রকম ভাজা থাকত দুপুরের মেনুতে।”
ভাইফোঁটা উপলক্ষে যে মিষ্টি তৈরি হত, তা বিভিন্ন রাজবাড়িতে উপহার হিসেবে মিষ্টি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। মিষ্টি পাঠানো হত কুঞ্জঘাটার রাজবাড়ি, জিয়াগঞ্জের রাজবাড়ি, নাটোরের রাজবাড়িতে। এমনকী কলকাতার পাথুরেঘাটা রাজবাড়িতে মিষ্টি যেত। ভাইঁফোঁটার দিন রাজপরিবারের সদস্যদের মজলিস বসত। সেখানে গান-বাজনা হত। এখন সেই সব কোথায়?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.