টুইটটা ভেসে উঠল টেস্ট শুরুর ঘণ্টা দেড়েক আগে।
‘নতুন দিন। নতুন সম্ভাবনার ঢেউ। আপনাদের শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ।’ টুইটটা করেছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। দূরের ব্রেকফাস্ট টেবিলে তখন দেখছি নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান সন্দীপ পাটিলকে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের আগে যে টেনশন আক্রান্ত করা উচিত, তাতে কুঞ্চিত পাটিল। টিম বার হয়েছে হোটেল থেকে সবে।
এই আবহে মাত্র এক বছর ভারতীয় দলে আসা অশ্বিনের টুইট মানে আধুনিক ক্রিকেটারের মগজ কত অন্য রকম ভাবে অপারেট করে! টেনশনে জবুথবু না হয়ে সে প্রযুক্তির মাধ্যমে দর্শক-ফ্যান-স্পনসর সবার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খোলা রাখে।
অবশ্য আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটারের মনঃস্তত্ত্বই কেবল বদলেছে। তার ম্যাচ জেতার সাবেকি মডেল বদলায়নি। অশ্বিন যখন ক্লাস টেন পাশ করেননি। আর খড়গপুর স্টেশনে টিকিট পরীক্ষকের চাকরি করেন কোনও এক এমএস ধোনি, সেই সময় থেকে আজও অপরিবর্তিত।
টস জেতো। বিপক্ষকে সহবাগে পিষে প্রথম দিন থেকে ওভার পিছু সাড়ে তিন রান করে তোলো। তার পর টার্নারে ফেলে যে ভাবে মাইক্রোওভেনে লোকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ফ্রায়েড চিকেন গরম করে, সে ভাবে নিজের মতো বানিয়ে নাও। |
ব্যতিক্রমী সহবাগ বিষ্যুদবারের মোতেরায়। ছবি: উৎপল সরকার |
মোতেরা ঐতিহাসিক ভাবে ভারতীয় স্ট্যাটিসটিশিয়ানের প্রিয় মাঠ হতে পারে। কপিল দেবের পরবর্তী কালে ভেঙে যাওয়া সর্বোচ্চ উইকেটপ্রাপ্তির বিশ্বরেকর্ড। গাওস্করের দশ হাজার রানের শৃঙ্গে প্রথম আরোহণ এখানে ঘটতে পারে। কিন্তু টিম ইন্ডিয়া-র প্রিয় স্টেডিয়াম কখনও নয়। আজ পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দু’বার এমন ঘটনা আছে যেখানে একটা আস্ত টিম প্রথম দিন প্রথম ব্যাট করে লাঞ্চের আগে অলআউট হয়ে গিয়েছে। বিশ্বে প্রথম বার এটা ঘটে লর্ডসে। বছরটা? নেতাজি জন্মানোর আগের বছর—১৮৯৬। আর দ্বিতীয় বার মোতেরায়। রুদ্রমূর্তি ধরা ডেল স্টেইনের সামনে সচিন, সহবাগ-সহ ভারত অলআউট হয়ে যায় ৭৬ রানে।
প্রতিহিংসা নেওয়ার সিরিজ যেহেতু আমদাবাদ দিয়ে শুরু হচ্ছে, ধোনিদের ব্যাপক দুশ্চিন্তা ছিল মোতেরা নিয়ে। দফায় দফায় পিচ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে যাতে শুকনো খটখটে তৈরি করা যায়। ঘাসের চিহ্নমাত্র না থাকে। তলাটা নড়বড়ে হয়। অর্থাৎ বিদ্যা বালন যেমন তাঁর আসন্ন বিয়েতে সব্যসাচীকে দিয়ে ডিজাইনার শাড়ি তৈরি করাচ্ছেন এবং জানেন পাড়টা ঠিক কী, আঁচলের কাজটা কেমন, ভারত অধিনায়কও তাই। যাতে অন্যায় কিছু নেই। কারণ ৪-০ ধ্বংসের সিরিজে অ্যান্ড্রু স্ট্রসের ইংল্যান্ড ঠিক একই কাজ করেছিল। আউটফিল্ড থেকে সময় সময় সবুজ উইকেট আলাদা করা যায়নি।
হিন্দি বক্স অফিস ছবিতে যেমন সাফল্যের সম্ভাব্য রেসিপিতে হিসেব করে গান, ফাইট, নাচ, হিউমার সব ঢোকানো থাকে, ভারতের মডেলে একটা ফ্যাক্টর লাগেই। বীরেন্দ্র সহবাগের ভাঙচুর। খাতা খুললে দেখা যাবে যাঁরা বেশি আলোকিত তাঁরা কেউ নন। না কপিল, না গাওস্কর, না সচিন। ভারতীয় ক্রিকেটের গ্রেটেস্ট দুই ম্যাচউইনার প্রথমে কুম্বলে। খুব কাছাকাছিতে সহবাগ।
এ দিন ব্যতিক্রমী, শৃঙ্খলিত একটা সেঞ্চুরি করলেন। উপমহাদেশে সহবাগ মানেই যে উন্মত্ত বাইসন বেরিয়ে পড়েছে সব কিছু থেঁতলে দিতে, আজকেরটা মোটেও তেমন নয়। শুরুর দিকটা বরঞ্চ শল্যচিকিৎসকের কুশলী নিয়ন্ত্রণ। প্রথম পঞ্চাশ রান এ ভাবে করতে দেখে সাংবাদিক শিল্ড বেরি দৌড়ে এলেন।
“আচ্ছা এটা কী প্রথম যে, সহবাগের পঞ্চাশে একটাও উঁচু শট নেই?” নিখুঁত উত্তর দেওয়া শক্ত। শিল্ডকে বললাম, সম্ভবত এই প্রথম।
অ্যালিস্টার কুক দিনের শেষে ভারতের ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে এক নম্বর খলনায়ক। কিন্তু ইংল্যান্ড অধিনায়ককে দিনের শেষে ভারতের ৩২৩-৪-এর জন্য যতই সমালোচনায় ঠেলে দেওয়া হোক, ইংরেজরা কিন্তু সহবাগ-গম্ভীরকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ীই বল করছিল। শর্ট রাখছিল। ড্রাইভ করার মতো দিচ্ছিল না। জায়গা দিচ্ছিল না অফে। কিন্তু সহবাগের তুখোড় গেম রিডিং। সামান্যতম সুযোগ পেলেন কী ফায়দা তুলে নিলেন। ৯০ বলে এল দু’বছর বাদে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি। যাতে রয়েছে ১৫ বাউন্ডারি, একটা ছক্কা। হিসেব খুব সহজ১৬ বল খেলে ৬৬। বাকি ৩৪ রান করতে নিয়েছেন ৭৪ বল। সহবাগের মাপে বিশাল সাবধানী ইনিংস।
প্রথম দু’ঘণ্টাতেই তিনি ইংল্যান্ড স্ট্র্যাটেজির ভ্রান্ত দিক স্পষ্ট করে দেন। এই পিচে ২+২ খেলা উচিত ছিল তাদের। কোনও মতেই ৩+১ নয়। গ্রেম সোয়ান দারুণ বল করে জিম লেকারের সঙ্গে তুলনীয় হলেন। কিন্তু সহবাগ ঝড় চলার সময় একা সোয়ান কী করবেন! চেতেশ্বর পূজারার সহজ ক্যাচ মিড অনে ছাড়লেন অ্যান্ডারসন। ওটা ধরতে পারলে ইংল্যান্ডকে এত বিপন্ন প্রথম দিনের শেষেই দেখাত না। পূজারা আপাতত সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ২ রান দূরে। দ্রাবিড়ের ছায়া তাঁর মধ্যে এখনও নেই। তবে বেডিং-টেডিং নিয়ে পুরনো মুম্বই স্কুলের পিচে চলে আসার যে প্রতিজ্ঞা তা পুরোদমে রয়েছে। যুবরাজ এবং তিনি দু’জনেই আন্ডারডগ এবং সে জন্যই পার্টনারশিপটা আরও দেওয়ালির সবচেয়ে বর্জনীয় বাজির মতো দেখাচ্ছে। সচিন মাঝে ফিরে গিয়েছেন মাত্র ১৩ করে। কিন্তু পায়ের নড়াচড়া আর কনফিডেন্স দেখে মনে হয়েছে বড় রান বুঝি টোস্টারে চাপানো আছে। এই রুটিটা সেঁকেটেকে পরের টেস্টগুলোয় নামল বলে!
টেস্ট পাঁচ দিন চলবে না এমন ভবিষ্যদ্বাণী প্রথম দিনের শেষেই শোনা যাচ্ছে। আর একটা রেকর্ডও উল্লিখিত হচ্ছে। দেশের মাঠে প্রথম উইকেটে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ হলে ভারত সেই টেস্ট কখনও হারেনি। ক্রিকেট মানেই অনিশ্চয়তা। তবু মনে হচ্ছে ডিজাইনার পিচ কাঙ্খিত ফল দেওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
|
মোতেরা টেস্টের স্কোরবোর্ড
ভারত (প্রথম ইনিংস) ৩২৩-৪ |
গম্ভীর বো সোয়ান ৪৫
সহবাগ বো সোয়ান ১১৭
পুজারা ব্যাটিং ৯৮
তেন্ডুলকর ক পটেল বো সোয়ান ১৩
কোহলি বো সোয়ান ১৯
যুবরাজ ব্যাটিং ২৪
অতিরিক্ত ৭।
মোট ৩২৩-৪।
পতন: ১৩৪, ২২৪, ২৫০, ২৮৩।
বোলিং: অ্যান্ডারসন: ১৭-৩-৬৬-০, ব্রড ১৭-১-৭১-০, ব্রেসনান ১০-০-৫৬-০
সোয়ান ৩২-৫-৮৫-৪, পটেল ১৪-২-৩৯-০। |
|
|