|
|
|
|
জমি-বাড়ি দিচ্ছে সরকার, নিতে নারাজ গ্রামবাসী |
অভিজিৎ চক্রবর্তী • চন্দ্রকোনা
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের পরে জমি নিয়ে নেওয়া নিয়ে যখন রাজ্য জুড়েই জটিলতা চলছে, তখন একেবারে উল্টো ছবি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায়। সেখানে সরকার জমি দিচ্ছে। কিছু দিন পরে বাড়িও বানিয়ে দেবে। রাস্তা, পানীয় জল, পুকুর, এমনকী রোজগারের জন্য মাছ চাষ ও প্রাণিপালনের ব্যবস্থাও করে দেবে সরকার। তবু সে সব নিতে রাজি হচ্ছেন না দরিদ্র গ্রামবাসী।
‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’ প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছেন প্রশাসনিক কর্তারা। ডিসেম্বরের মধ্যে জেলার ৩ হাজার উপভোক্তাকে জমি ও বাড়ির পাট্টা তুলে দিতে চাইছে প্রশাসন। চন্দ্রকোনা ২ ব্লকের কুঁয়াপুর পঞ্চায়েতের লালগড় মৌজায় ৩ একর জমিতে কলোনি তৈরি কথা। সেখানে ১৩০ জনকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। ব্লকের ২৪ জন বাস্তুজমির পাট্টাও
নিয়ে নিয়েছেন। বেঁকে বসেছেন জনা কুড়ি উপভোক্তা। এঁরা সকলেই বিপিএল। নিজের নামে জমি-বাড়িও নেই। তবু কেন সরকারের বাড়িতে যেতে অনীহা? |
|
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এই বাড়িতেই থাকেন শ্রীমন্ত পূজারি।—নিজস্ব চিত্র। |
কুঁয়াপুর গ্রামে বাবার পাট্টা পাওয়া জমিতে থাকেন দুই ভাই শ্রীমন্ত ও হেমন্ত পূজারি। উপভোক্তা তালিকায় নাম রয়েছে শ্রীমন্তর। তাঁর কথায়, “ছোট জায়গায় থাকতেও কষ্ট। কিন্তু এখানে নিয়মিত কাজ পাই। ওখানে গিয়ে যদি কাজ না জোটে?” কুঁয়াপুর বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করে সংসার চালানো দীনেশ ঘোষ বলে, “আমাদের গ্রাম থেকে লালগড় ৯ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে কি এই বাজারে এসে বসতে পারব? নাকি সেখানে গিয়ে অন্য বাজারে বসার সুযোগ পাব?” মনোরঞ্জন মাইতি, অরূপ হালদারের মতো আরও যাঁরা নিমরাজি, তাঁদেরও বাবার নামে কৃষিজমির পাট্টা আছে। সেখানেই ঘর তুলে কয়েক পুরুষ ধরে আছেন তাঁরা।
নিয়মমতো দারিদ্রসীমার নীচে থাকা, ভূমিহীনদের এই প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার কথা। জমির বন্দোবস্ত করে দেবে সরকার। পরে ইন্দিরা আবাস, আমার বাড়ি, আমার ঠিকানা’র মতো কোনও একটি প্রকল্পে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। চন্দ্রকোনার যে জনা কুড়ি বাসিন্দা প্রকল্পের সুবিধা নিতে চাইছেন না, তাঁরা বিপিএল তালিকাভুক্ত, নিজের নামে জমি-বাড়িও নেই। ফলে, উপভোক্তার তালিকায় ঠাঁই পেতে নিয়মে বাধেনি। কিন্তু এঁদের প্রত্যেকেরই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে। সেই আস্তানা ঘিরে তাঁদের একটা নিশ্চিন্ত জীবনও গড়ে উঠেছে। তাই সহজেই সরকারি প্রকল্পের আহ্বান ফিরিয়ে তাঁরা দাবি করতে পারছেন, নিজের এলাকাতেই বাড়ি দিতে হবে।
মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক অরিন্দম দত্ত বলেন, “পঞ্চায়েত থেকে তালিকা সংগ্রহের পর প্রশাসন ও পঞ্চায়েত যৌথ ভাবে তদন্ত করেছে। তার পরই উপভোক্তার তালিকা তৈরি হয়েছে।” অতএব তালিকায় ত্রুটি নেই। সমস্যাটা কোথায়? অতিরিক্ত জেলাশাসকের মতে, “মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন লোক ক’জন রয়েছে? সকলেই কিছু ব্যবস্থা করেছেন। তা সে নদীবাঁধের উপর ঝুপড়ি বানিয়ে হোক বা সরকারি জমি দখল করে। এঁদের অনেকেই ‘হোম-সিক’।” আর তাই ঠাঁইনাড়া হতে চাইছেন না। এঁদের দাবি, গ্রামেই বাড়ি বানিয়ে দিতে হবে।
সে ক্ষেত্রে সমস্যা কী? অতিরিক্ত জেলাশাসক বলেন, “সব গ্রামে সরকারি জমি নেই। যেখানে ভাল চাষ হয়, সেখানে কেউ সহজে জমি বিক্রি করতে চাইবেন না।” এমন সমস্যা আগেও হয়েছে। ২০০৬ সালে এই প্রকল্পেরই নাম ছিল ‘চাষ ও বসবাসের জন্য ভূমিদান প্রকল্প’। সে বছর ওই প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা পেয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর। তা দিয়ে ৪২ একর ৯৯ ডেসিমেল জমি কিনে ১০৮৮ জন উপভোক্তাকে বিলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখনও বসতি এলাকা থেকে দূরে, কাঁকুড়ে মাটি ইত্যাদি অভিযোগে অনেকে বাড়ি নিতে চাননি। প্রকল্পের ১ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা পড়ে রয়েছে।
রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রকল্পের নাম পাল্টে হয় ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’ নামে। স্থির হয় এক জন উপভোক্তাকে ৫ ডেসিমেল জমি দেওয়া হবে। কিন্তু আবারও জটিলতা দেখা দেওয়ায় উদ্বিগ্ন প্রশাসন। উপভোক্তাদের বোঝানো ছাড়া কোনও রাস্তাও নেই। আপাতত তাতেই আস্থা রাখছে প্রশাসন। |
|
|
|
|
|