জমির অনেকটাই দখল করে রেখেছে ইটভাটা। তাদের সরিয়ে জমি খালি করবে কে, তা নিয়ে দু’পক্ষে চাপান-উতোর চলছে। তাই এক বছরেও কাঁটাতার দিয়ে জমি ঘিরে ফেলার কাজ শুরুই করা যায়নি। উত্তরপাড়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ফিল্মসিটি প্রকল্পের যখন এই দশা, তখন মাত্র কয়েক দিন আগে, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রাজ্যে তিনটি ফিল্মসিটি তৈরি করতে চায় সরকার!
হুগলির উত্তরপাড়ায় কলকাতা পুরসভার ৮০ একর জমিতে
ফিল্মসিটি গড়ে তোলার কথা
ঘোষণা হয়েছিল বছর খানেক আগে। কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, চিত্রপরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী এবং অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক জায়গাটা ঘুরে দেখেন।
ঠিক হয়, গঙ্গার তীরে, কলকাতা পুরসভার ওই ৮০ একর জমিতেই তৈরি হবে ফিল্মসিটি। কলকাতা পুরসভা জমিটি ঘিরে রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দেবে। ফিল্মসিটি তৈরির কথা সরকারেরই। কিন্তু জমির একটা বড় অংশ এখনও বেআইনি ভাবে দখল হয়ে থাকায় চিহ্নিত এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরার কাজই শুরু করা যায়নি। দখলদার সরিয়ে, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরার পরে ফিল্মসিটি তৈরির কাজ কবে শুরু হবে, তা জানেন না উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভা-কর্তৃপক্ষ।
সমস্যাটা ঠিক কোথায়? উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পিনাকী ধামালি বলেন, “জায়গাটি কলকাতা পুরসভার হলেও দীর্ঘকাল ধরে সেখানে ১১টি ইটভাটা রয়েছে। সেগুলিকে কেন্দ্র করে ওই জমিতে বাস করেন বিহার থেকে আসা বেশ কিছু মানুষ। জমির লাগোয়া গঙ্গা বরাবর ৮টি ঘাট আছে। সেই সব ঘাট নিয়মিত ব্যবহার করেন স্থানীয় মানুষ। তাই বিকল্প ব্যবস্থা না করে পুরো জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা যাবে না।” |
পিনাকীবাবুর কথায়, “কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে ওই জায়গাটা মাপজোক করতে বলা হয়েছিল। আমরা তা করে দিয়েছি। কিন্তু ওই জমিতে যে সব ইটভাটা ও শ্রমিকেরা আছেন, তাঁদের সরানোর দায়িত্ব নিতে হবে কলকাতা পুরসভাকেই।” অন্য দিকে কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “ওই জমিতে ইটভাটার ব্যবসা চলছে। তাই স্থানীয় পুর কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়েই ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে ফয়সালা করতে হবে।” যদিও উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভা সেই দায়িত্ব নিতে নারাজ।
উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভা সূত্রের খবর, সমাধান খুঁজতে ইটভাটা মালিকদের সঙ্গে একটা মাত্র বৈঠক করেছে জেলা প্রশাসন। শ্রীরামপুর সদর প্রশাসকের অফিসে ডাকা ওই বৈঠকে ইটভাটার মালিকেরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিকল্প জায়গা না দেওয়া হলে তাঁরা জমি ছাড়বেন না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাল্টা বলা হয়, ১১টি ইটভাটাকে দেওয়ার মতো জায়গা নেই। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তার পর আর কোনও আলোচনাই হয়নি। ফলে সেই অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে প্রস্তাবিত ফিল্মসিটির জমি।
মুখ্যমন্ত্রী সাধের প্রকল্পের জন্য এমন বিতর্কিত জমি পুরসভা কেন পছন্দ করল? পুরসভার এক কর্তা বলেন, “গঙ্গার ধারে এক লপ্তে এমন জমি পুরসভার কাছে আর ছিল না। তাই মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করতে ওই জমিটিকেই নির্দিষ্ট করা হয় ফিল্মসিটির জন্য।”
গত বছর দলবল নিয়ে মেয়র ওই জমি দেখে চূড়ান্ত করার পরেও পুরসভার তরফে ওই প্রকল্প নিয়ে কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি। প্রকল্পটি কেন আটকে রয়েছে, তা নিয়েও কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না পুরসভার তরফে। সংস্থা সূত্রের খবর, পুজোর আগে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী পুর কমিশনারের কাছে একটি চিঠি লিখে জানতে চান, উত্তরপাড়া ফিল্মসিটির কাজ কতটা এগিয়েছে। তার পরেই পুর কমিশনার খলিল আহমেদ উত্তরপাড়ায় প্রস্তাবিত ফিল্মসিটি এলাকা ঘুরে আসেন। খলিল জানান, জায়গাটি ঘেরার জন্য উত্তরপাড়া-কোতরং পুর কর্তৃপক্ষকে টাকাও দেওয়া হয়েছে।
পিনাকীবাবু বলেন, “পুরো জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরার জন্য ৩৭ লাখ টাকার মতো খরচ হবে। সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা ১৭ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছে। এ বার কাজের টেন্ডার ডাকা হবে। তবে ইটভাটাগুলি সরানোর দায়িত্ব আমরা নেব না।”
তা হলে পুরো জমি ঘেরা হবে কী ভাবে? পিনাকীবাবু বলেন, “পুরো জমি একেবারে ঘিরে ফেলা যাবে না। যেখানে দখল রয়েছে, সেই জমি ছেড়ে অন্যত্র কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে।” বছর ঘুরে গেলেও প্রস্তাবিত ফিল্মসিটির কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় চিন্তিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত অনেকেই। স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক অনুপ ঘোষাল বলেন, “প্রস্তাবের কথা বার বার শুনেছি। তবে কত দূর কী হয়েছে, তা জানি না।” ফিল্মসিটি তৈরির গোড়াতেই বিলম্ব নিয়ে চিত্র পরিচালক হরনাথবাবু বলেন, “ওটা সরকারের ব্যাপার। আমার কিছু বলার নেই।”
যে জমিতে ফিল্মসিটি হওয়ার কথা, সেখানে দখল করে থাকা ইটভাটার মালিকদের বক্তব্য, তাঁদের সঙ্গে সরকারি স্তরে এখনও কেউ কথা বলেননি। এক ইটভাটার মালিক বাবলু মণ্ডল বলেন, “ব্রিটিশ আমলের ইটভাটা আমাদের। এখন শুনছি ফিল্মসিটি হবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কেউ আলোচনা করেননি। যা শুনছি, যা দেখছি, তা টিভি আর কাগজে। আমাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প ব্যবসার জায়গা, সব কিছু নিয়েই আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা বা নোটিস দেওয়া কোনওটাই হয়নি।”
উত্তরপাড়ায় গঙ্গার পাড়ে অপর একটি ইটভাটা চালান অরিন্দম শাখা। তিনি বলেন, “যতটা জমির কথা বলা হচ্ছে সরকারি স্তরে, এখানে অত জমিই নেই এখন! গঙ্গার ভাঙনে অনেকটা জমিই চলে গিয়েছে। সরকারি স্তরে যা বলা হচ্ছে, তা থেকে স্পষ্ট, এখানে কেউ এসে ব্যবসা করবেন। সরকার আমাদের দিয়ে দিক জমি। আমরাই তো ব্যবসা করছি লিজ নিয়ে। ভিন রাজ্যের বহু শ্রমিক এখানে কাজ করেন। আগের সরকার বলেছিল আবাসন করবে। কিছু হয়নি।
এখন শুনছি ফিল্ম সিটি হবে। আমাদের কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। তবে জোর করে কিছু করতে গেলে আমরা আপত্তি জানাব।” |