বেহিসেবি ব্যয়ে কোষাগারে নাভিশ্বাস
ভাত জোগাতেই পকেট ফাঁকা, ঘি আসছে ধারে
র্থিক বোঝার চাপে নিত্য দিন ত্রাহি মধুসূদন দশা। সেই বোঝার উপরে এ বার চেপেছে ধানের আঁটি। যার ভারে প্রায় কপর্দকশূন্য রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র!
এমনিতেই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, ব্যয়ে আবার বাহুল্যের বহর কম নয়। তাই রোজগার বাড়লেও পশ্চিমবঙ্গের ভাঁড়ারে ‘নেই নেই’ অবস্থা যেন কাটে না। পরিস্থিতি এখন আরও সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। উৎসবের মরসুমে বাড়তি পাওনাগণ্ডা মেটানোর দায় তো আছেই, উপরন্তু এ মাসে ধান সংগ্রহের জন্য পাঁচশো কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ায় রাজকোষ কার্যত ভগবানের ভরসায় চলে গিয়েছে বলে অর্থ দফতর সূত্রের খবর।
বাধ্য হয়ে কোমর বেঁধে কোষাগার সামলাতে নেমেছেন অর্থ-আধিকারিকেরা। আপাতত তাঁদের লক্ষ্য, যেন অন্তত টানা ১৪ দিন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে অগ্রিম নিতে না-হয় (কারণ, সে ক্ষেত্রে রোজকার খরচ চালাতে ওভারড্রাফ্ট নেওয়া ছাড়া গতি থাকবে না)। তাই পূর্ত (সড়ক), জনস্বাস্থ্য, সেচ, ক্ষুদ্রসেচে কাজের বিল আটকে রাখা হচ্ছে। নজর পড়েছে পুর-নগরোন্নয়ন, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, সর্বশিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন বা কৃষিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের দিকেও।
সব মিলিয়ে বেহিসেবি ব্যয়ের মাসুল গুনতে কোপ পড়ছে উন্নয়নে। বিভিন্ন দফতর-সূত্রের খবর, রাজ্যের নিজস্ব উন্নয়ন কাজকর্ম প্রায় স্তব্ধ। চালু বলতে একশো দিনের কাজ, ইন্দিরা আবাস বা সর্বশিক্ষার মতো সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সাহায্যপুষ্ট কিছু প্রকল্প। সরকারি কর্মীদের বেতন-পেনশন বা অফিস খোলা রাখার টাকা পেতে রাজ্যের বড় ভরসা ঋণ। বাজার থেকে এন্তার ধার করা হচ্ছে। “ধারের উপর ধার। ঋণই যেন সরকারের সঞ্জীবনী।” মন্তব্য প্রশাসনের এক কর্তার।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
অর্থ-কর্তারা জানিয়েছেন, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অমিতবাবু বিধানসভায় ঘোষণা করেছিলেন, সরকার খরচে লাগাম টানবে, পরিকল্পনা ব্যয় বাড়িয়ে পরিকাঠামো নির্মাণে জোর দেবে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, সেতু, বিদ্যুৎ, পানীয় জলের প্রকল্পে আরও টাকা মিলবে। পরিকাঠামোর পথ ধরে আসবে নতুন শিল্প, বাড়বে রাজ্যের সামগ্রিক রোজগার। বস্তুত আয়বৃদ্ধির ইঙ্গিতও মিলেছে। দফতরের তথ্য অনুযায়ী, মাসে গড়ে ১০০ কোটি টাকা পণ্য-প্রবেশ কর আদায় হচ্ছে। স্ট্যাম্প ডিউটিও আসছে ভাল। শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা হাজার কোটি টাকা স্ট্যাম্প ডিউটি এনে দিয়েছে। ২০১২-র সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ-শুল্ক জমা পড়েছে ৮০০ কোটি। আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট আদায় সন্তোষজনক। সব মিলিয়ে প্রথম ছ’মাসে রাজস্ব আদায় ১৪ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে।
আর এটা অনুমান করেই অর্থমন্ত্রী বাজেটে পরিকল্পনা খাতে ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেন, যা গত বছরের তুলনায় ১১.৬% বেশি। দফতরগুলোকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বরাদ্দের ৭৫% খরচ করার আগাম অনুমতিও দিয়ে রেখেছে অর্থ দফতর। তবু অধিকাংশ দফতর ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি খরচ করে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ, উন্নয়নে বরাদ্দের সিংহভাগই খরচ হয়নি। এবং এ জন্য আঙুল উঠছে পরিকল্পনা-বহির্ভূত বিপুল ব্যয়ের দিকে।
হিসেবও তা-ই বলছে। এ বারের বাজেটে পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ৮২ হাজার কোটি। ইতিমধ্যে তিনশো কোটি বাড়তি গলে গিয়েছে। পাশাপাশি প্রথম আট মাসে ট্রেজারি থেকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা অগ্রিম তোলা হয়েছে, দু’মাসের মধ্যে যার হিসেব জমা পড়ার কথা। কিন্তু খরচে যেমন আগ্রহ, হিসেব পেশে তেমন আগ্রহ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ করছেন অর্থ দফতরের একাধিক কর্তা।
অর্থাৎ, বেহিসেবি খরচে কার্যত লাগাম নেই। অর্থ-কর্তাদের বক্তব্য: বাজেটে নেই, এমন কিছু খাতে কিছু খরচ করা হলে আর্থিক শৃঙ্খলার নিয়মে তা ‘নিরর্থক’ ব্যয়। এমনকী, সেই টাকা ‘জনহিতার্থে’ কাজে লাগলেও। ঘটনা হল, গত আট মাস যাবৎ রাজ্যে বাজেট-বহির্ভূত এমন বহু খরচ হয়ে চলেছে। ইমাম-ভাতা থেকে বিষ-মদে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের মতো মুখ্যমন্ত্রীর নানা ঘোষণাও এর মধ্যে পড়ে। একই ভাবে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের পিছনে তিন কোটি টাকা ঢেলেছে তথ্য সংস্কৃতি দফতর, বাম জমানার শেষ বছরে যা আধ কোটি ছাড়ায়নি। প্রশাসনিক মহলের একাংশের দাবি, এ জাতীয় বাজেট-বহির্ভূত খরচের জেরে তহবিলে টান পড়ায় এক বছর কর্মীদের মহার্ঘভাতাও দিতে পারেনি সরকার। বকেয়া সেই ডিএ-র এক কিস্তি মেটাতে হবে জানুয়ারিতে। তাতে সরকারের ঘাড়ে চাপবে বাড়তি অন্তত দেড়শো কোটির দায়।

অমিতের মাসকাবারি
প্রথম সপ্তাহ পয়লা তারিখে আসে কেন্দ্রীয় করের প্রাপ্য ১৫০০ কোটি। ট্রেজারিতে রোজ ৬০ থেকে ৮০ কোটি জমা। পকেট মোটা। দ্বিতীয় সপ্তাহ টানাটানি শুরু। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ৩০০-৭০০ কোটি অগ্রিম। কোন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকানো যায়, তার ভাবনা।

তৃতীয় সপ্তাহ পরের মাসে বেতন মেটাতে বাজার থেকে ১০০০-৩০০০ কোটি ঋণ তুলতে চেয়ে আবেদন। ম্যাচিং গ্রান্ট, কেন্দ্রের টাকায় হাত। সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অগ্রিম। এ সপ্তাহেই সঙ্কট তুঙ্গে। শেষ সপ্তাহ বাজারি ঋণের টাকায় বেতন মিটিয়ে ফের পয়লা তারিখের অপেক্ষা।

বাহুল্যের বোঝা


এ দিকে বোঝার উপরে ইতিমধ্যে চেপেছে ধানের ভার। এবং তাতেই কোষাগার রীতিমতো নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে বলে সরকারি-কর্তাদের একাংশের দাবি। কী রকম?
মহাকরণের খবর: আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে এ বছরে সাড়ে ২২ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থ দফতর জানায়, অত টাকা (প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি) দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। স্থির হয়, নাবার্ডের ঋণ নিয়ে ধান কিনবে রাজ্য। কিন্তু সময়ে ঋণ মেলেনি। তার উপরে গত বছরের পাওনা বকেয়া থাকায় চালকলগুলোও ধান কিনতে নামেনি। ফলে ১৫ অক্টোবর থেকে ধান সংগ্রহ শুরুই হয়নি। চাষিদের ক্ষোভ আঁচ করে খাদ্য দফতর পুজোর পরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দরবার করে। তখন অর্থ দফতর বাধ্য হয়ে পাঁচশো কোটি টাকা দিয়ে বকেয়া মিটিয়েছে। ঠিক হয়েছে, চালকলগুলো ২৭ নভেম্বর ধান কেনা শুরু করবে। প্রশাসনের একাংশের মতে, পুজোর মাসে বরাবরই আয় হয় অনেক কম, ব্যয় বহু বেশি। তাই পুজোর ঠিক পরেই ট্রেজারিতে রাশ টানাটা দস্তুর। অথচ ঠিক এই সময়ে ধানের পিছনে পাঁচ-পাঁচশো কোটি বেরিয়ে যাওয়ায় কোষাগারে কার্যত হাঁড়ির হাল হয়েছে।
এমতাবস্থায় বাহুল্যের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সরকারি মহলে। যেখানে ভাত জোগানোর চাল কিনতেই ফতুর হওয়ার জোগাড়, সেখানে ওই সব খরচকে ‘ধার করে ঘি খাওয়া’র সামিল বলে মনে করছেন কর্তাদের অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, এ হেন সঙ্কটে বিল আটকে কতটা কাজ হবে?
কাজ হচ্ছেও না। সংসার চালাতে রাজ্যকে তাই ফি মাসে বাজার থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। তবে তারও সীমা আছে। বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন মোতাবেক, চলতি অর্থবর্ষে সাড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবে পশ্চিমবঙ্গ। তার ১২ হাজার কোটি ইতিমধ্যে নেওয়া হয়ে গিয়েছে। নভেম্বরে আরও ৩ হাজার কোটি ঋণ তোলার অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রকে আবেদন জানিয়েছে মহাকরণ। তা পাওয়া গেলে আট মাসেই ১৫ হাজার কোটি টাকার কোটা পূরণ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে শেষের এক-দু’মাস চলবে কী করে, তা নিয়েও কিছুটা ধন্দে রয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.